আমরা জাবেদ চাচাকে খুঁজে পেলাম না। নিশাত আপু বললেন শহরে গিয়েছেন, আমরা রাঙামাটি কীভাবে কোন পথে যাব সেসব ব্যাপারে খোঁজ নিতে। রাতে খাবার সময়ে থাকবেন। কাজেই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আমি আর সুজন তখন ছোঁক ছোঁক করে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। অন্যেরা বসে বসে টুয়েন্টি ফোর খেলছে আমরা তাদের সাথে খেলতেও পারি না, আবার কিছু না করে বসেও থাকতে পারি না।
শেষ পর্যন্ত জাবেদ চাচার সাথে দেখা হল। আমি বললাম, “জাবেদ চাচা, আপনার সাথে আমাদের একটু কথা বলতে হবে।”
জাবেদ চাচা খুব কম কথা বলেন, তারপরেও হাসি হাসি মুখে বললেন, “তোমাদের সাথেও আমার কথা বলতে হবে।”
“আমাদেরটা খুবই জরুরি।”
জাবেদ চাচার মুখের হাসিটা আরো বড় হল, “আমারটাও খুবই জরুরি।”
“আগে আমাদেরটা বলি?”
“বলবে? বল।”
আমরা যখন বলতে শুরু করলাম ঠিক তখন নিশাত আপু ঘরে ঢুকলেন, খাওয়া-দাওয়া হোটেল বিল এই সব নিয়ে কথা বলতে লাগলেন তাই আমাদের আর বলা হল না। জাবেদ চাচা আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমরা ডাইনিং টেবিলে খেতে খেতে কথা বলি?”
আমরা আর কী করব? মাথা নেড়ে রাজি হয়ে চলে এলাম।
রাতে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছি। আজকে চাইনিজ খাবার, দেখে জিবে পানি এসে যাবার কথা কিন্তু আমার আর সুজনের ভেতরে এতো অশান্তি যে শান্তি মতো খেতে পারব এরকম মনে হচ্ছে না। খাওয়া যখন প্রায় মাঝামাঝি তখন নিশাত আপু আর জাবেদ চাচা এলেন। জাবেদ চাচা জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের খবর কী? সবাই ভালো?”
আমি আর সুজন চুপ করে রইলাম, অন্যেরা মাথা নেড়ে কেউ বলল, “ভালো।” কেউ বলল, “খুবই ভালো” কেউ বলল, “ফাটাফাটি” কেউ বলল, “সুপার ডুপার।”
জাবেদ চাচা বললেন, “একেক জায়গায় আমরা দুই রাত করে থাকব। কাজেই বান্দরবানে এটা শেষ রাত। কাল দুপুরে আমরা রাঙামাটি রওনা দিব।”
আমি আর সুজন আবার চুপ করে থাকলাম, অন্যেরা আনন্দের মতো শব্দ করল। জাবেদ চাচা বললেন, “আজকে আমি শহরে গিয়েছিলাম, সেখানে আমার পরিচিত একজনের সাথে দেখা হয়েছে, সে বলেছে এখন বান্দরবান খুবই গরম একটা জায়গা।”
“গরম?” মামুন বলল, “আমাদের তো সেরকম গরম লাগছে না!”
“এটা অন্য রকম গরম।”
“কী রকম গরম?”
“আর্মসের বিশাল একটা চালান এসেছে এই এলাকায়, পুলিশ মিলিটারি ধরার চেষ্টা করছে।”
আমি আর সুজন একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। রিতু বলল, “মনে নাই পুলিশ মিলিটারি ব্যারিকেড দিয়ে সব গাড়ি চেক করছে?”
মামুন জিজ্ঞেস করল, “কী রকম আর্মস?”
“একে ফরটি সেভেন। গ্রেনেড।”
“গ্রেনেড?”
“হ্যাঁ গ্রেনেড।”
“সর্বনাশ।”
রিতু জানতে চাইল, “কারা করে?”
“মানুষটার নাম হচ্ছে কাদের। কাদের বক্স। অসম্ভব নিষ্ঠুর একটা মানুষ। কোনো মায়া দয়া নাই। তার একটা বড় দল আছে, পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে রেখেছে। পাহাড়ে থাকে, কোথায় থাকে কেউ জানে না।”
আমি আর সুজন একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। সুজন তার শুকনো ঠোঁট জিব দিয়ে ভেজানোর চেষ্টা করে বলল, “মায়া দয়া নাই মানে? কী করে?”
“খুন জখম। নিজের দলের মানুষও যদি একটু উনিশ-বিশ করে তা হলে গুলি করে মেরে পাহাড় থেকে নিচে ফেলে দেয়।”
“কী সাংঘাতিক!”
আঁখি বলল, “কাদের বক্স যদি খুব সাংঘাতিকও হয় আমাদের তো ভয় পাওয়ার কিছু নাই। আমরা তো কাদের বক্সের দলের মানুষ না। আমরা তো তার আর্মসের ব্যবসারও কোনো ক্ষতি করছি না।”
আমি বুঝতে পারলাম আমাদের এখন আসল কথাটা বলার সময় হয়েছে। যেই মুখ খুলেছি ঠিক তখন শুনলাম ধুপধাপ শব্দ করে কারা যেন দৌড়ে আসছে। কিছু বোঝার আগেই অনেকগুলো মানুষ ছুটে এলো, তাদের সবার মুখ গামছা দিয়ে বেঁধে রেখেছে যেন চেহারা দেখা না যায়, সবার হাতে ভয়ংকর এক ধরনের রাইফেল যেগুলো শুধুমাত্র ইংরেজি সিনেমায় দেখা যায়। মানুষগুলো ডাইনিং রুমে ঢুকে এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যায়। ডাইনিং রুমে যারা খাচ্ছিল তারা ভয়ে চিৎকার করে উঠে। তখন রাইফেল হাতে একজন বলল, “খবরদার! কোনো শব্দ না।”
সাথে সাথে সবাই চুপ করে গেল।
আঁখি ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী হয়েছে?”
আমার গলা দিয়ে শব্দ বের হতে চাইছিল না, কোনোমতে ফিসফিস করে বললাম, “মুখ বাঁধা অনেকগুলো মানুষ, হাতে বন্দুক, ভিতরে এসে ঢুকেছে।”
“এরা কারা?”
“জানি না। মনে হয় ডাকাত।”
“সর্বনাশ!”
মুখ বেঁধে রাখা যে মানুষগুলো ডাইনিং রুমে ঢুকেছে তারা চারিদিকে তাকিয়ে দেখে, তখন একজন চিৎকার করে বলল, “সবগুলো এইখানে।”
রিসোর্টের ভিতরে যারা ছোটাছুটি করছিল তারা তখন ডাইনিং রুমের দিকে আসতে থাকে। এরা কার খোঁজে এসেছে, কাকে পেয়ে গেছে সেটা কেউ বুঝতে পারেনি। শুধু আমি আর সুজন বুঝে গিয়েছি। তাই মানুষগুলো আমাদের টেবিলে এসে যখন খপ করে আমাদের ছয়জনকে ধরে টেনে-হিঁচড়ে টেবিল থেকে বের করে নিয়ে আসে তখন সবাই অবাক হয়ে ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। শুধু আমি আর সুজন অবাক হলাম না, চিৎকারও করলাম না।
জাবেদ চাচা লাফ দিয়ে উঠে বললেন, “কী হচ্ছে? কী হচ্ছে এখানে?”
পিছনে যে মানুষটা ছিল সে রাইফেলটা তুলে তার পিছনটা দিয়ে জাবেদ চাচার বুকে প্রচণ্ড জোরে মেরে বসল। জাবেদ চাচা যন্ত্রণায় একটা শব্দ করে নিচে পড়ে গেলেন। মানুষটা রাইফেলটা জাবেদ চাচার দিকে তাক করে বলল, “আর একটা টু শব্দ করবে তো শেষ করে দেব।”