আমরা আসলে সেটা খেয়াল করিনি, ড্রাইভার চাচার কথা শুনে মনে হল তার কথা সত্যি। আমরা যখন প্রথম গাড়িতে সবজির টুকরিগুলো তুলেছি তখন বুড়ো মানুষটার খুবই কাঁচুমাচু ভাব ছিল, যখন টুকরিগুলো নামানোর সময় হল তখন বুড়ো মানুষটার হাবভাব রীতিমতো রুক্ষ। তবে সেটা নিয়ে আমরা বেশি মাথা ঘামালাম না, একটা মানুষকে বিপদের সময় সাহায্য করেছি সেটাই বড় কথা। সেই মানুষের যদি দ্রতা বা কৃতজ্ঞতা না থাকে আমরা কী করব?
রিসোর্টের সামনে গাড়ি থামল, প্রথমে মামুন নামল। তারপর আঁখি, তারপর রিতু আর শান্তা। আমি যেই নামতে যাব সুজন তখন খপ করে আমার হাত ধরল। আমি অবাক হয়ে বললাম, “কী হয়েছে সুজন?”
সুজন তার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, “শ-স-স-স।”
আমি গলা নামিয়ে বললাম, “কী হয়েছে?”
সুজন ফিসফিস করে বলল, “বুড়ো মানুষটার সবজির টুকরিতে কী ছিল জানিস?”
“কী?”
“এই দেখ।” সুজন তার ব্যাকপেকের মুখটা খুলে দেখাল, আমি তাকিয়ে দেখলাম সবুজ রংয়ের গোল মতোন একটা জিনিস। আমি ভালো করে তাকালাম, তারপর ভয়ানকভাবে চমকে উঠলাম, “গ্রেনেড!”
“হ্যাঁ।”
“তুই কেমন করে পেলি?”
“হাত দিয়ে দেখছিলাম কী আছে, দুটি সরিয়েছি।”
“কেন?”
সুজন ঢোক গিলে বলল, “জানি না।”
আমি সুজনের দিকে আর সুজন আমার দিকে তাকিয়ে রইল!
১১-১২. অস্ত্র ব্যবসায়ীর কথা
যখন আমরা কাদের বক্স নামে ভয়ংকর নিষ্ঠুর একজন অস্ত্র ব্যবসায়ীর কথা জানতে পারলাম
আমি সুজনকে জিজ্ঞেস করলাম, “এখন কী করবি?”
সুজন শুকনো মুখে বলল, “জানি না। তুই বল কী করব?”
আমি মাথা চুলকালাম, বললাম”বড়দের বলতে হবে। নিশাত আপু আর জাবেদ চাচাকে।”
সুজন বলল, “আমি বলতে পারব না। তুই বল।”
“আমি কী বলব?”
”যেটা হয়েছে সেটাই বলবি।”
“তুই বুঝতে পেরেছিস আমরা কী করেছি? মিলিটারি পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে যাদের ধরার চেষ্টা করছে আমরা তাদেরকে সাহায্য করেছি। আমরা তাদের অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ আমাদের গাড়িতে করে পৌঁছে দিয়েছি!”
সুজন শুকনো মুখে বলল, “তার মানে আমরাও এখন অপরাধী? পুলিশ এখন আমাদের ধরবে।”
আমি মাথা নাড়লাম, “মনে হয়।”
সুজন বলল, “কিন্তু আমরা তো ইচ্ছে করে করিনি। বুড়ো বদমাইশটাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম।”
“সেটা পুলিশকে বলে দেখ তারা কী বলে! তারা আমাদের বিশ্বাস করে ছেড়ে দিয়েছে। আমাদের গাড়ি চেক করবে না বুড়োটা সেটা জানে, সেই জন্যেই বুড়োটা তার টুকরিগুলো আমাদের গাড়িতে তুলেছে। কেউ যেন দেখতে না পায় সেই জন্যে ঠেলে ঠেলে সিটের নিচে রেখেছে। চেকআপ করার আগে নেমে গেছে। আমাদের পুলিশকে বলা উচিত ছিল একজন লোকের সবজির টুকরি আমরা নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা চেক করে দেখেন।”
সুজন মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিকই বলেছিস।”
“এখন বলে কী লাভ?” আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “আর তুই কেন খামোখা সবজির টুকরি ঘটতে গেলি? সবজির টুকরি থেকে তুই যদি এই গ্রেনেডগুলো খুঁজে বের না করতি তা হলে আমরা কোনোদিন জানতেও পারতাম না যে এর ভেতরে এগুলো আছে। আমরা ভাবতাম আমরা একজন বুড়ো মানুষকে সাহায্য করেছি। সেটা চিন্তা করে খুশি থাকতাম!”
সুজন বলল”এখন সেটা বলে লাভ নেই। কী করবি তাড়াতাড়ি ঠিক কর সবাই না হলে সন্দেহ করবে।”
মামুন বাথরুমে ঢুকেছে, আমি অন্যদের বলেছি আমরা নিচ থেকে আমাদের রুমগুলোর ছবি তুলব, সেই জন্যে একটু বাইরে যাচ্ছি। এই মুহূর্তে একটা গাছের নিচে ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়ে সুজনের সাথে কথা বলছি, সুজনের পিঠে তার ব্যাকপেক সেটার ভিতরে দুইটা তাজা গ্রেনেড। আমি বললাম, “যাই করি আর না করি সবার আগে এই গ্রেনেড দুইটা তোর ব্যাকপেক থেকে বের করে এখানে কোথাও রাখ।”
সুজন গ্রেনেড দুটি বের করল। গাঢ় সবুজ রংয়ের উপরে খাঁজকাটা। ঠিক সিনেমাতে যেরকম দেখেছি। সুজন একটা রিং ধরে বলল, “এই রিংগুলো কী? টান দিলে কী হবে?”
আরেকটু হলে সুজন সত্যি সত্যি টান দিয়ে পিনটা খুলে ফেলত, আমি থামালাম, “সর্বনাশ! পিন খুললেই সাত সেকেন্ড পরে গ্রেনেড ফেটে যায় জানিস না? সবাইকে মারবি না কি?”
সুজন জানত না। আমরা সবাই যেরকম একশ রকম বই পড়ি একশ রকম জিনিস জানি, সুজন সেইরকম না। সে বই পড়ে কম কিন্তু একশ রকম দুষ্টুমি জানে। তার দুষ্টুমির ফল হচ্ছে এই দুইটা গ্রেনেড। আমরা গাছের নিচে ঝোঁপের আড়ালে গ্রেনেড দুটি রেখে কয়েকটা শুকনো পাতা দিয়ে ঢেকে ফেলে বের হয়ে এলাম। আমাদের ঘরের বারান্দায় রিতু আর শান্তা দাঁড়িয়ে নিচে আমাদের দেখে বলল, “তোরা ওখানে কী করছিস?”
আমি বললাম, “ছবি তুলছি। তোরা দাঁড়া, তোদেরও একটা ছবি তুলি।”
রিতু আর শান্তা দুজন দুজনকে ধরে একটা নেকু নেকু ভঙ্গিতে দাঁড়াল, আমি একটা ছবি তুলোম। ছবি তুলে আমরা আমাদের রুমের দিকে আগালাম। আমি এখনো বুঝতে পারছি না বিষয়টা অন্য সবাইকে বলা ঠিক হবে কি না। আমাদের মাঝে রিতুর বুদ্ধি বিবেচনা সবচেয়ে বেশি, ব্যাপারটা তার সাথে আলোচনা করতে পারলে হত, কিন্তু কীভাবে আলোচনা করব বুঝতে পারছিলাম না। রিতুকে আলাদাভাবে পাওয়া দরকার কিন্তু সে সারাক্ষণই অন্যদের সাথে কথা বলছে, গল্পগুজব করছে। এক হতে পারে শুধু রিতুকে না বলে সবাইকে ব্যাপারটা খুলে বলি। শান্তা অল্পতেই ঘাবড়ে যায়, পুরোটা জানলে ভয় পেতে পারে। আঁখিকে এখন জানানোর কোনো প্রশ্নই আসে না। সে আমাদের সবাইকে নিয়ে বেড়াতে এসেছে আর আমরা অস্ত্র চোরাচালানির দলের সাথে গোলমাল শুরু করেছি এই কথাগুলো তাকে বলব কেমন করে? এই মানুষগুলো যখন ফিরে গিয়ে দেখবে তাদের টুকরিতে দুইটা গ্রেনেড কম তখন কি আর সেই দুইটা গ্রেনেডের জন্যে ফিরে আসবে না? আর যখন বুঝতে পারবে আমরা জেনে গেছি তখন কি আমাদের ছেড়ে দেবে? খুঁজে খুঁজে বের করে ফেলবে না আমরা কোথায়? ভয়ে দুশ্চিন্তায় আমার পেটের ভাত চাউল হয়ে যাবার অবস্থা।