আমরা বললাম, “জি।”
“কোথায় যাচ্ছ?”
“মার্কেটে।”
“যাও।”
রিতু জিজ্ঞেস করল, “আপনি গিয়েছেন মার্কেটে?”
অফিসারটি হাসল, “ঘুমানোর সময় পাই না–আর মার্কেট!”
“আপনার কিছু লাগবে মার্কেট থেকে?”
অফিসারটি হাসল, “না, মা লাগবে না।”
ড্রাইভার চাচা তখন গাড়ি ছেড়ে দিল। রিতু কতো সহজে সুন্দর করে কথা বলতে পারে, এই কথাটাই যদি আমি বলতাম কী বেখাপ্পা শোনাতো। আর সুজন যদি বলত তা হলে নির্ঘাত একটা মারামারি লেগে যেত।
জাবেদ চাচার কথা সত্যি। এখন মার্কেটে সেরকম ভিড় নেই। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম আর মেয়েরা একটু কেনাকাটা করল। সুজন শুধু একটা তামাক খাবার বাঁশের পাইপ কিনল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কেন কিনেছিস? তুই কি পাইপ খাস?”
“বড় হয়ে খাব তাই কিনে রাখলাম।” এই কথার আর কী জবাব দেওয়া যায়?
.
আমরা যখন ফিরে আসছি তখন একটা মোড় ঘুরতেই দেখলাম পথের মাঝে একটা ভ্যান উল্টে পড়ে আছে, রাস্তায় কয়েকটা টুকরি, টুকরিতে শাকসবজি, কিছু শাকসবজি টুকরিতে কিছু রাস্তায় পড়ে আছে। ভ্যানের পাশে একজন বুড়ো মতো মানুষ হতাশভাবে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। শান্তা বলল, “আহা বেচারা।”
আঁখি বলল, “কী হয়েছে?”
“একজন বুড়ো মানুষের ভ্যান উল্টে তার শাকসবজি রাস্তায় পড়ে গেছে!”
তখন আঁখিও বলল, “আহা বেচারা।
বুড়ো মানুষটা আমাদের গাড়ি দেখে হাত তুলল, ড্রাইভার চাচা গাড়ি থামিয়ে বললেন, “কী হল?”
“আমার সবজিগুলো একটু তুলে পৌঁছে দেবেন?”
ড্রাইভার চাচা কী একটা বলতে যাচ্ছিল, আমরা তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই গাড়ি থেকে নেমে সবজিগুলো টুকরিতে তুলে দিলাম। রিতু জিজ্ঞেস করল, “আপনি ব্যথা পেয়েছেন?”
বুড়ো মতোন মানুষটা একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “একটু পেয়েছি। তারপর গাড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল, “ভ্যানটা তো গেছে সবজিগুলো বাজারে নেওয়া দরকার, তোমাদের গাড়ি করে একটু পৌঁছে দেওয়া যাবে মা?”
রিতু বলল, “আমাদের হোটেল পর্যন্ত যেতে পারেন।”
মানুষটা বলল, “তা হলেই হবে। আমি বাকিটা নিয়ে যেতে পারব।”
ড্রাইভার চাচা কেন জানি পুরো ব্যাপারটাতে খুবই বিরক্ত হলেন, কিন্তু আমরা বুড়ো মানুষটাকে তার সবজিসহ তুলে নিলাম। মানুষটা বারবার বলতে লাগল, “বুড়ো মানুষ, শরীরে আর জোর পাই না। তোমরা তুলে না নিলে কী করতাম কে জানে! আজকাল মানুষের মনে দয়া মায়া নাই।”
যখন গাড়ি ছেড়েছে তখন বুড়ো মানুষটা সবজির টুকরিগুলো ধাক্কা দিয়ে সিটের নিচে ঠেলে দিতে লাগল। আমি বললাম, “সিটের নিচে ঢুকাতে হবে না। বাইরে থাকুক।”
বুড়ো মানুষটা বলল, “না, না, একটু চোখের আড়াল করে দিই। তোমাদের এতো সুন্দর গাড়িতে এই শাকসবজি, আলু, কদু দেখতে কি ভালো লাগবে?”
আমরা মানুষটাকে বোঝাতে পারলাম না যে সবজির টুকরি বাইরে থাকলে কিছুই আসে যায় না!
আমরা যখন বেশ অনেক দূর চলে এসেছি তখন হঠাৎ করে বুড়ো মানুষটা কেমন জানি চমকে উঠল, একবার নিজের কোমরে হাত দিল তারপর এদিক সেদিক কী একটা খুঁজতে লাগল। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”
“আমার ব্যাগ।”
“কী ব্যাগ?”
“টাকা-পয়সার ব্যাগ-মনে হয় ওখানে পড়ে গেছে!” মানুষটা কেমন জানি ব্যস্ত হয়ে গেল, “ড্রাইভার সাহেব! গাড়িটা একটু থামান।” ড্রাইভার চাচা বিরক্ত হয়ে বললেন, “কেন?”
“আমাকে নামিয়ে দেন, আমার ব্যাগ ফেলে এসেছি।”
রিতু বলল, “আপনার সবজির টুকরি?”
“গাড়িতে থাকুক। আমার লোক গাড়ি থেকে নিয়ে নেবে।”
ড্রাইভার চাচা গাড়ি থামালেন, বুড়ো মানুষটা হুড়মুড় করে গাড়ি থেকে নেমে গেল। বেচারা গরিব মানুষ, এখন তার টাকার ব্যাগটা খুঁজে পেলে হয়।
ড্রাইভার চাচা বিরক্ত হয়ে বুড়ো মানুষটাকে একটা গালি দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল। একটু সামনেই আবার পুলিশ ব্যারিকেড, অনেকগুলো গাড়ি থামিয়ে চেক করছে। গাড়ির লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলে দেরি হত। কিন্তু মিলিটারির সেই অফিসারটা আমাদের দেখল। বলল, “মার্কেটিং করেছ?”
“জি। করেছি।”
“গুড। যাও। তোমরা চলে যাও।
ড্রাইভার চাচা অন্যদের পাশ কাটিয়ে চলে এলেন। আমরা যখন আমাদের রিসোর্টের কাছে এসেছি তখন হঠাৎ দেখলাম রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বুড়ো মানুষটা হাত নাড়ছে। ড্রাইভার চাচা গাড়ি থামালেন, জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি না পিছনে গেলেন, এখন সামনে চলে এসেছেন কেমন করে?”
বুড়ো মানুষটাকে তার উত্তর দেবার জন্যে খুব বেশি আগ্রহ দেখা গেল না, হাত নেড়ে বলল, “ঐ তো একজনকে পেয়ে গেলাম, হোন্ডায় নামিয়ে দিল!”
ড্রাইভার চাচা বললেন, “দেখলাম না তো কোনো হোন্ডা।”
বুড়ো মানুষটা বলল, “খুলেন, খুলেন, টুকরিগুলো দেন।” বলে নিজেই দরজা খুলে তার টুকরিগুলো নিতে থাকে।
সুজনকে হঠাৎ কেমন জানি উত্তেজিত দেখায়। সে কী একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। আমি তার দিকে তাকালাম, এর আগে কখনো দেখিনি যে সুজন কোনো কথা বলতে গিয়ে থেমে গেছে। বুড়ো মানুষটা একা নয়, হঠাৎ করে কোথা থেকে বেশ অনেকগুলো মানুষ জড়ো হয়েছে, তারা সবাই মিলে খুব তাড়াতাড়ি টুকরিগুলো নামিয়ে নিল। কাছেই একটা”চান্দের গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল, সেটাতে তুলে গাড়িটা দ্রুত সামনের দিকে চলে যায়।
ড্রাইভার চাচা গজগজ করতে করতে বললেন, “আমরা তার মাল সামান এনে দিলাম, সেই জন্যে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিল না, সেটা খেয়াল করেছ?”