আসার পথে আবার পুলিশ মিলিটারির দলটা আমাদের গাড়িকে থামাল। এবারে আগের অফিসারটি নেই। তাই আবার জাবেদ চাচাকে আমাদের নিয়ে একটু প্রশ্ন করল। আমাদের একনজর দেখে গাড়ির ভিতরে একটু চোখ বুলিয়ে আমাদের ছেড়ে দিল।
রিসোর্টে পৌঁছে প্রথমেই আমরা ধড়াস করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। মামুন বলল, “ঘুরে বেড়ানোর সময় কেউ কোনো কাজ করে না। কিন্তু কেমন পরিশ্রম হয় দেখেছিস?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ! বান্দরবান এখনো শুরুই করিনি। রাঙামাটি কক্সবাজার বাকি, এখনই টায়ার্ড হলে কেমন করে হবে?”
সুজন বিছানায় উঠে বসে বলল, “কে বলেছে টায়ার্ড হয়েছি। মোটেই টায়ার্ড হইনি! কী মজা হচ্ছে দেখেছিস? কোনো কিছু নিজেদের করতে হচ্ছে না। খাওয়ার সময় খাওয়া, ঘুমের সময় ঘুম! এই দেখ সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানাটা উল্টাপাল্টা করে গেছিলাম, বাথরুমটা নোংরা করে গেছিলাম কেউ এসে বিছানাটা বানিয়ে দিয়েছে, বাথরুমটা পরিষ্কার ঝকঝকে তকতকে করে দিয়েছে! কেউ বকা দিচ্ছে না, টেবিল পরিষ্কার করতে দিচ্ছে না। যা ইচ্ছে তাই করতে পারি! কী মজা।”
মামুন উঠে বসে বলল, “আসলেই! এবারে বেশি মজা হচ্ছে। আরেকবার বেড়াতে গিয়েছিলাম সাথে বড় মানুষেরা ছিল তারা সবসময় ধমক দিচ্ছে, এটা করো না সেটা করো না। এবারে সেগুলো নাই।”
সুজন বলল, “ইচ্ছে হলে বরং আমরাই ধমক দিয়ে দিতে পারব।”
আমিও তাদের সাথে সাথে মাথা নাড়লাম, কিন্তু আমি আগে কখনোই একা একা কোথাও যাইনি। অনেক মজা আর অনেক আরাম হচ্ছে ঠিকই কিন্তু আমার মাঝে মাঝেই আম্মুর কথা মনে হচ্ছে। সেটা অবশ্যি ওদেরকে বলা যাবে না তা হলে আমাকে নিয়ে নিশ্চয়ই হাসাহাসি করবে।
ডাইনিং রুমে খাবার টেবিলে বসে খাবারের জন্যে অপেক্ষা করছি তখন নিশাত আপু জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা সবাই মজা করছ তো?”
“করছি।” শান্তা একটু থেমে বলল, “তবে মাঝে মাঝেই বাসার কথা মনে হচ্ছে।” আমি বললাম, “আমারও!”
“সেটা খুবই স্বাভাবিক। তোমরা প্রত্যেকদিন একেবারে নিয়ম করে বাসায় কথা বলবে। ঠিক আছে?”
“বলব।”
“যখন কথা বলার ইচ্ছে করবে আমাকে বলবে।”
সুজন বলল, “বজলুর সাথে কথা বলে দেখি, ওর নানার কী খবর।”
আঁখি বলল, “আহা বেচারা।”
নিশাত আপু বললেন, “বজলুর টেলিফোন নম্বর আছে কারো কাছে?”
শান্তা বলল, “আছে।” তারপর ব্যাগ থেকে ছোট একটা নোট বই বের করে বজলুর আব্বুর টেলিফোন নম্বর বের করে নিশাত আপুকে দিল। নিশাত আপু ফোন ডায়াল করে টেলিফোনটা সুজনকে ধরিয়ে দিলেন। ফোনে কথা বলার একটু ভদ্রতা আছে সুজন তার ধারেকাছে গেল না, সোজাসুজি জিজ্ঞেস করল, “বজলু আছে?”
একটু পর বজলু ফোন ধরল, সুজন জিজ্ঞেস করল, “তোর নানা মারা গেছেন?”
সুজনের কথা বলার ধরন দেখে আমরা রীতিমতো চমকে উঠলাম। অন্য পাশ থেকে বজলু কী বলেছে শুনতে পেলাম না কিন্তু শুনলাম সুজন অবাক হয়ে বলছে, “এখনো মারা যান নাই! মনে হচ্ছে মারা যাবেন না। ভালো হয়ে যাবেন। কী সর্বনাশ!”
সুজনের কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করলাম। সুজন নিশাত আপুকে ফোনটা দিয়ে বলল, “বজলুর খুবই মন খারাপ।”
“কেন?”
“নানা মারা যাবেন সেই জন্যে বজলু আসতে পারল না। এখন ওর নানা না কী ভালো হয়ে যাচ্ছেন! বজলু খুবই বিরক্ত।”
রিতু কিছুক্ষণ সুজনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তুই কি সবসময় এভাবে কথা বলিস?”
সুজন অবাক হয়ে বলল, “কীভাবে কথা বলি?”
শান্তা জিজ্ঞেস করল, “তুই জানিস না তুই কীভাবে কথা বলিস?”
“জানব না কেন? এই যে কথা বলছি।”
রিতু বলল, “না সুজন তোর কথা বলার ধরন ভালো না। তোকে সুন্দর করে কথা বলা শিখতে হবে।”
সুজন মুখ শক্ত করে বলল, “আমাকে তোদের কথা বলা শিখাতে হবে না। আমি অনেক সুন্দর করে কথা বলি।”
ঠিক তখন টেবিলে খাবার দিতে শুরু করল আর আমরা খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তাই সুন্দর করে কথা বলার ব্যাপারটা চাপা পড়ে গেল। অনেক ভালো ভালো খাবার, চিকেন টিকিয়া, শিককাবাব, পোলাও, সবজি, ঘন ডাল, খাবার পর দই এবং মিষ্টি।
খাওয়া শেষ করে নিশাত আপু বললেন, “বেশি খেয়ে ফেলেছি। এখন বিছানায় শুয়ে টানা ঘুম দিতে পারলে হত।”
রিতু বলল, “আপনি ঘুমান নিশাত আপু।”
“না, না–তোমরা বিকেলে ঐ মার্কেটে যাবে মনে নাই। জাবেদ চাচাকেও শহরে যেতে হবে। তোমাদের সাথে যেতে পারবেন না।”
আমি বললাম, “আমরা নিজেরা নিজেরা যেতে পারব।”
শান্তা বলল, “ড্রাইভার চাচা থাকবেন। আমরা তো অন্য কোথাও যাচ্ছি –মার্কেটে যাব একটু দেখব তারপর চলে আসব। আপনার কষ্ট করে আমাদের সাথে যেতে হবে না।”
নিশাত আপু তার পরেও খুঁতখুঁত করতে লাগলেন, “না না, চাচা একশবার বলে দিয়েছেন তোমাদেরকে যেন একা ছাড়া না হয়।”
আঁখি হি হি করে হেসে বলল, “আমরা ছয়জন একা হলাম কেমন করে?”
সুজন বলল, “সাথে ড্রাইভার চাচা।”
নাদুসনুদুস মোটাসোটা মানুষের ঘুম খুব প্রিয়, তাই নিশাত আপু শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলেন। আমাদেরকে গাড়িতে তুলে অনেক রকম উপদেশ দিয়ে নিশাত আপু ঘুমাতে গেলেন। ড্রাইভার চাচা আমাদের ছয়জনকে নিয়ে রওনা দিলেন মার্কেটে।
আমরা গাড়িতে চেঁচামেচি করে যেতে থাকি। বেসুরো গলায় গান গাইতে থাকি, সেই গান শুনে আঁখি হেসে কুটি কুটি হয়ে যায়। রাস্তায় আবার সেই পুলিশ আর মিলিটারির ব্যারিকেড-এবারে আমরা সকালের অফিসারটাকে পেয়ে গেলাম। আমাদেরকে দেখে এগিয়ে এসে বলল, “তোমরা আবার?”