এর মাঝে একসময় নিশাত আপু এসে আমাদের খোঁজ নিয়ে গেলেন। বলেছেন আটটার ভিতরে ডাইনিং হলে চলে আসতে, নাস্তা খেয়ে আমরা বের হব। আমরা আটটার আগেই সবাই ডাইনিং রুমে চলে এসেছি। ভোরবেলা অনেকে নাস্তা করেই বের হয়ে যাবে। সকালেও আঁখি ঠিক স্বাভাবিক মানুষের মতো হেঁটে এসেছে। আমরা এবারে আরেকটা মজার ব্যাপার লক্ষ করলাম, রিসোর্টের ম্যানেজার নিশ্চয়ই আঁখির ব্যাপারটা জানে কিন্তু কোন জন আঁখি ধরতে পারছেন না। রিতু তখন দুষ্টুমি করে ভান করতে লাগল সে দেখতে পায় না। কোনো কিছু ধরার আগে একটু হাত বুলিয়ে জিনিসটা দেখে সোজা একদৃষ্টে একদিকে তাকিয়ে থাকে। কথা বলার সময় কারো দিকে তাকায় না! ম্যানেজার সাহেব তখন ধারণা করে নিলেন রিতুই হচ্ছে আঁখি। ডাইনিং টেবিলে খাবার দেওয়ার সময় তখন রিসোর্টের সবাই মিলে রিতুর যত্ন করতে লাগল!
নাস্তা করেই আমরা বের হয়ে গেলাম। বাইরে গাড়ি অপেক্ষা করছিল, জাবেদ চাচা গাড়িতে ওঠার আগে ড্রাইভার চাচাকে জিজ্ঞেস করলেন, “রতন, পাহাড়ি রাস্তায় তুমি গাড়ি চালাতে পারবে তো? অসুবিধে হলে বল, তা হলে আমরা লোকাল ড্রাইভার নিয়ে একটা চান্দের গাড়ি ভাড়া করে নিই!”
ড্রাইভার চাচা এমনভাবে হেসে উঠলেন যে তার থেকে বোঝা গেল কেউ তার জীবনে এরকম হাস্যকর কথা বলেনি। তিনি থাকতে আরেকজন গাড়ি চালাবে সেটি কিছুতেই হতে পারে না। এ ধরনের একটা কথা বলাই তার জন্যে বড় ধরনের অপমান।
আমরা আবার গাড়িতে উঠে বসেছি। আগের মতোন ড্রাইভারের পাশের সিটে জাবেদ চাচা। পিছনে নিশাত আপু। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে গাড়ি যেতে থাকে। আমরা শহরে মানুষ হয়েছি কখনো বনজঙ্গল দেখিনি, রাস্তার দুই পাশে জঙ্গল দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। পাহাড়ি রাস্তা, কখনো উঁচু কখনো নিচু হঠাৎ হঠাৎ দূরে একটা নদী চিকচিক করে ওঠে দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই।
একটা বড় টিলাঘরে যাবার সময় হঠাৎ দেখি রাস্তার পাশে বেশ কিছু পুলিশ মিলিটারি দাঁড়িয়ে আছে। তারা হাত তুলে আমাদের গাড়ি থামাল। কঠিন চেহারার একজন মিলিটারি গাড়ির ভিতরে আমাদেরকে একনজর দেখে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাবেন?”
জাবেদ চাচা বললেন, “এখনো জানি না, বাচ্চাগুলো যতদূর যেতে চায়।”
নিশাত আপু বললেন, “কোনো সমস্যা?”
মিলিটারি মানুষটা কোনো উত্তর না দিয়ে গাড়ির ভিতরে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল।
এরকম সময় কমবয়সী আরেকজন মিলিটারি এল, তাকে দেখে কঠিন চেহারার মানুষটা একটা সেলুট দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তার মানে কমবয়সী এই মানুষটা নিশ্চয়ই অফিসার। নিশাত আপু তখন জানালা দিয়ে মাথা বের করে বললেন, “এখানে কী কোনো কিছু হয়েছে? কোনো সমস্যা?”
কমবয়সী অফিসারটি বলল, “না! আপনাদের কোনো সমস্যা না।”
“তা হলে আপনাদের সমস্যা?”
অফিসারটি হাসার চেষ্টা করে বলল, “আমাদের তো সবসময়ই সমস্যা। আমাদের কাজই হল সবাইকে সন্দেহ করা, সবার গাড়ি চেক করা।”
রিতু জানালা দিয়ে মাথা বের করে জিজ্ঞেস করল, “আপনারা কী চেক করেন?”
“এই তো! কেউ ড্রাগস নিচ্ছে কি না, আর্মস নিচ্ছে কি না এই সব দেখি।”
রিতু হেসে বলল, “আমরা এসব কিছু নিচ্ছি না।”
অফিসারটি বলল, “জানি! তবু দেখতে হয়। এটাই হচ্ছে আমাদের ডিউটি!” তারপর হাত নেড়ে ড্রাইভারকে চলে যেতে বলল।
আঁখি বলল, “আহা বেচারা।”
শান্তা জিজ্ঞেস করল, “কেন আহা বেচারা?”
“এই যে এরকম একটা সুন্দর জায়গায় থাকে, কিন্তু তাদের কাজটা হচ্ছে সবাইকে সন্দেহ করা!”
আমরা মাথা নাড়লাম, আঁখি ঠিকই বলেছে।
.
গাড়ি করে ঘুরে ঘুরে আমরা উপরে উঠতে থাকি। আমাদের মতো আরো অনেকে বেড়াতে এসেছে, মাঝে মাঝেই তারা পথের ধারে গাড়ি থামিয়ে ছবি তুলছে। আমরাও একটা সুন্দর জায়গায় গাড়ি থামালাম। এক পাশে পাহাড়ি ঢাল তাই আঁখিকে শান্তা ধরে রাখল। আমরাও কিছু ছবি তুলোম, নিশাত আপুর কাছে একটা ভিডিও ক্যামেরা, সেটা দিয়ে ভিডিও করলেন।
আমরা আবার গাড়িতে উঠেছি, আবার গাড়ি করে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি পথের পাশে একটা জায়গায় অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, অনেক মানুষের ভিড়। শান্তা জিজ্ঞেস করল, “ওখানে কী হচ্ছে?”
নিশাত আপু বললেন, “একটা ছোট বাজারের মতোন। পাহাড়ি মানুষদের হাতে তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি হয়।”
রিতু বলল, “আমরা থামি?”
নিশাত আপু বললেন, “ঠিক আছে।”
আমরা গাড়ি থেকে নেমে আবিষ্কার করলাম, মানুষের ভিড় ঠেলে আমরা যেতে পারব কিন্তু আঁখির বেশ অসুবিধে হবে। সে চোখে দেখতে পায় না বলে তাকে সবকিছু হাত বুলিয়ে দেখতে হয়। এখন যে ঠেলাঠেলি হচ্ছে হাত বুলানো দূরে থাকুক ভালো করে কেউ চোখ দিয়েও দেখতে পাবে না! জাবেদ চাচা বললেন, “সকালে এখানে খুব ভিড় হয়। তোমরা বিকালের দিকে এসো তখন নিরিবিলি ঘুরে দেখতে পারবে।”
আমরা রাজি হয়ে গেলাম। বান্দরবানের পাহাড়ে এসে কারো ভিড় ঠেলাঠেলি করতে ইচ্ছে করছে না।
প্রায় তিন ঘণ্টা পাহাড়ে ঘোরাঘুরি করে আমরা টের পেলাম আমাদের বেশ খিদে পেয়েছে। নিশাত আপু বললেন, “চল এখন রিসোর্টে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ করে নিই!”
লাঞ্চের কথা শুনে খিদেটা এক মুহূর্তে চাগিয়ে উঠল। খানিকটা দূরে না কী একটা জলপ্রপাত আছে, আমরা আপাতত সেটা না দেখেই ফিরে আসতে শুরু করি। পেটে খিদে থাকলে কোনো কিছুই ভালো লাগে না, কোনো কিছুই সুন্দর দেখায় না।