“আর ড্রাইভার চাচা?”
“তাকে নিয়েও তোমার চিন্তা করতে হবে না। নিচে তার জন্যেও থাকার জায়গা আছে। তোমরা হাত-মুখ ধুয়ে রেডি হয়ে যাও, আমাদের নিচে ডাইনিং রুমে খাবার দিলে তোমাদের ডেকে নেব। আজকের মেনু স্যার টেলিফোনে ঠিক করে দিয়েছেন। কাল থেকে তোমরা বলবে কোন বেলায় তোমরা কী খেতে চাও।”
ম্যানেজার সাহেব আমাদেরকে রেখে নিশাত আপু আর জাবেদ চাচাকে নিয়ে চলে গেলেন। আমরা নিজেদের রুমে ঢুকে হাত-মুখ ধুয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে নিলাম। বাথরুমে সাবান শ্যাম্পু টুব্রাশ টুথপেস্ট এমনকি দাড়ি কামানোর জন্যে রেজর পর্যন্ত আছে। আমাদের দাড়ি গজায়নি বলে ব্যবহার করতে পারব না! সবার জন্যে ধবধবে সাদা পরিষ্কার টাওয়েল। তিনটা বিছানা তিন দিকে। চাঁদরগুলোও ধবধবে সাদা। বড় কাঁচের জানালা, ভারী পর্দা। সুন্দর একটা টেবিল। ঘরটার মেঝে মনে হল কাঠ দিয়ে তৈরি, ঘরের বাইরে বড় বারান্দা সেখানে খুব সুন্দর হেলান দেওয়া চেয়ার।
কিছুক্ষণের মাঝেই আঁখি, রিতু আর শান্তাও বের হয়ে এলো। আমরা তখন পাহাড় বেয়ে নিচে নেমে গেলাম। এক পাশে বড় ডাইনিং রুম, সেখানে আমাদের জন্যে আলাদা করে একটা টেবিল সাজানো হয়েছে। নিশাত আপু আর জাবেদ চাচা আগেই সেখানে বসে আছেন। ডাইনিং রুমের মাঝে আলাদা আলাদা টেবিলে আরো অনেকে বসে আছে। কেউ খাচ্ছে, কেউ খাবারের জন্যে অপেক্ষা করছে, কেউ খেয়ে গল্পগুজব করছে। আমাদের দিকে সবাই একনজর তাকিয়ে নিজেদের মাঝে ব্যস্ত হয়ে গেল। কেউ দ্বিতীয়বার ঘুরে তাকাল না। আঁখি একেবারে স্বাভাবিক মানুষের মতো হেঁটে এসেছে, চেয়ারে বসেছে গল্পগুজব করছে কেউ সন্দেহ করল না যে সে অন্যরকম।
আঁখি ফিসফিস করে বলল, “বুঝলি? এই জীবনে প্রথম কেউ আমাকে দেখে আহা উঁহু করছে না! কী মজা।”
আমি গলা নামিয়ে বললাম, “দেখিস, কেউ বুঝতেই পারবে না।”
আমরা অনেক সময় নিয়ে খেলাম। তারপর নিজেদের রুমে ফিরে গেলাম। বারান্দায় চেয়ারগুলোতে বসে আমরা নিচু স্বরে গল্প করতে থাকি। আকাশে অপূর্ব একটা চাঁদ উঠেছে আর তার নরম জোছনা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। বাতাসে গাছের পাতা শিরশির করে নড়ছে। বহু দূর থেকে কোনো একটা বুনো প্রাণীর ডাক শুনলাম। মাথার উপর দিয়ে অনেকগুলো পাখি কেমন যেন দুঃখী গলায় ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল।
আমরা চুপচাপ বসে রইলাম। আঁখি প্রথমে গুনগুন করে তারপর নিচু গলায় গান গাইতে শুরু করল, “আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে–”। কী সুন্দর তার গলা।
আঁখি তো জোছনা দেখছে না তা হলে কেমন করে জানল আমরা জ্যোৎস্না রাতে বনে এসেছি?
.
১০.
যখন সবকিছুই ঠিক ঠিক চলছিল কিন্তু না বুঝেই আমরা একটা খুব বড় বিপদে পা দিয়ে ফেললাম
খুব সকালে আমার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ বুঝতে পারলাম না আমি কোথায়। হঠাৎ করে মনে পড়ল তখন আমি উঠে বসে চারিদিকে তাকালাম। রাত্রিবেলা উজ্জ্বল আলোতে ঘরটাকে এক রকম লেগেছিল, সকালের আবছা আলোতে আবার অন্যরকম লাগছে। আমি বিছানা থেকে নেমে অন্য দুটি বিছানায় শুয়ে থাকা মামুন আর সুজনকে দেখলাম। প্রত্যেকটা মানুষের মনে হয় ঘুমানোর নিজস্ব একটা স্টাইল আছে। মামুন দুই হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়েছে–সুজন ঘুমিয়েছে একেবারে গুটিসুটি মেরে। আমি তাদেরকে ঘুম থেকে না জাগিয়ে বাইরে বারান্দায় গিয়ে একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলাম। চারিদিকে অনেক গাছ, সেই গাছে হাজার হাজার পাখি কিচিরমিচির করছে। আমি নিচে তাকালাম, অনেক নিচ দিয়ে একটা নদী এঁকেবেঁকে যাচ্ছে, এটা নিশ্চয়ই শঙ্খ নদী। পাহাড় জঙ্গল নদী কোথাও কোনো মানুষ নেই। নির্জন সুনসান দেখে কী অবাক লাগে।
আমি চুপচাপ অনেকক্ষণ বসেছিলাম তখন খুট করে শব্দ হল। তাকিয়ে দেখি দরজা খুলে ঘুম ঘুম চোখে রিতু বের হয়ে আসছে। আমাকে দেখে বলল, “তুই এখানে বসে আছিস? কতক্ষণ থেকে?”
“ঘুম ভেঙে গেল, তাই বসে আছি।”
রিতু বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওমা! কী সুন্দর।”
“হ্যাঁ, খুব সুন্দর।”
”সবচেয়ে সুন্দর কোন জিনিসটা, বল দেখি?”
“কোনটা?”
“কোনো টেম্পো গাড়ি নাই। মানুষজন নাই। চিৎকার চেঁচামেচি নাই।”
আমি মাথা নাড়লাম। বললাম, “ঠিকই বলেছিস।”
রিতু কিছুক্ষণ আমার পাশে চুপচাপ বসে থেকে বলল, “এই হোটেলটা কি সুন্দর দেখেছিস?”
আমি বললাম, “হোটেল না! এইটা হচ্ছে রিসোর্ট!”
“দুইটার মাঝে পার্থক্য কী?”
আমি বললাম, “জানি না। মনে হয় হোটেল হচ্ছে বড়লোকদের জন্যে আর রিসোর্ট হচ্ছে আরো বেশি বড়লোকদের জন্যে।”
রিতু হাসল। বলল, “হ্যাঁ এখানে সবকিছুর মাঝে একটা বড়লোক বড়লোক ভাব। কালকে রাতে যখন আমরা খাচ্ছি তখন নিশ্চয়ই কয়েক হাজার টাকা বিল হয়েছে!”
“আমাদের এই ঘরগুলোও নিশ্চয়ই এক দিনে কয়েক হাজার টাকা ভাড়া।”
রিতু মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিকই বলেছিস। বড়লোকেরা কীভাবে থাকে সেটা একটু আন্দাজ হল!”
আমরা হি হি করে হাসলাম।
.
কিছুক্ষণের মাঝে অন্যেরাও ঘুম থেকে উঠে গেল, তখন সবাই মিলে হইচই করে বাথরুমে গিয়ে রেডি হতে থাকি। আমরা যখন স্কুলে একজন আরেকজনকে দেখি তখন একভাবে দেখা হয়, আর যখন এভাবে একসাথে থাকি তখন অন্যভাবে দেখা হয়। যেমন মামুন হচ্ছে আমাদের মাঝে সায়েন্টিস্ট মানুষ, তার হওয়ার কথা ভুলাভালা টাইপের কিন্তু সে হচ্ছে সবচেয়ে চটপটে। সুজন হচ্ছে দুষ্টু নাম্বার ওয়ান তার হওয়ার কথা সবচেয়ে চটপটে সে হচ্ছে সবচেয়ে ঢিলে! বাথরুমে ঢুকলে বেরই হতে চায় না।