মামুন বলল, “আমাদের হেড স্যার বলেছেন।”
মানুষটা তার বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, “তোমার হেড স্যার কাঁচকলা জানে।”
এরকম একটা বেয়াদপ মানুষের সাথে কথা বলাই ঠিক না তারপরেও মামুন চলে গেল না, জিজ্ঞেস করল, “তা হলে ইলেকট্রিসিটি কেমন করে তৈরি হয়?”
“জেনারেটর দিয়ে। চুম্বকের মাঝে কয়েলকে ঘুরাতে হয়।”
“কেমন করে ঘুরায়?”
“মোটর দিয়ে, টারবাইন দিয়ে, গায়ে জোর থাকলে হাত দিয়ে—”
মানুষটা মশকরা করছে কি না আমরা বুঝতে পারলাম না। মামুন আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছিল কিন্তু বেয়াদপ মানুষটা আমাদের বিদায় করে দিয়ে বলল, “যাও যাও ঝামেলা কর না।”
মামুন হচ্ছে আমাদের সায়েন্টিস্ট কিন্তু সে আসলে একটু গাধা টাইপের মানুষ। পরের দিন ক্লাসে সে হেড স্যারকে বলল, “স্যার পানি ফেললে ইলেকট্রিসিটি হয় না। ইলেকট্রিসিটি তৈরি করতে হলে চুম্বকের মাঝে কয়েলকে ঘুরাতে হয়।”
হেড স্যার ভুরু কুঁচকে বললেন, “কী বললি? অ্যাঁ?”
মামুন একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “না মানে-ইয়ে–”
হেড স্যার এগিয়ে এসে বললেন, “অ্যাঁ বেশি বড় মাতবর হয়েছিস?”
মামুন চি চি করে বলল, “না স্যার হই নাই।”
হেড স্যার খপ করে মামুনের কান ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “কান টেনে ছিঁড়ে ফেলব অ্যাঁ বেয়াদপ ছেলে। আঁ!”
কানটা শেষ পর্যন্ত ছিঁড়েন নাই কিন্তু টেনে যে একটু লম্বা করে দিয়েছেন সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই। মামুন বেঞ্চে বসে গজগজ করতে লাগল, ফিসফিস করে বলল, “কিছু জানেন না বুঝেন না–আর হয়েছেন হেড মাস্টার!”
কাজেই নোট বই যদিও এক্সপার্ট হেড মাস্টাররা লিখে থাকে কিন্তু তারা যদি আমাদের হেড স্যারের মতো হেড মাস্টার হয়ে থাকেন তা হলে সেগুলো পড়ে কোনো লাভ নেই, আম্মুকে সেই কথা বলাও যাবে না। বাসায় তা হলে অশান্তি শুরু হয়ে যাবে।
.
আমার বাসায় যেরকম শান্তি নেই স্কুলে সেরকম শান্তি নেই। লেখাপড়ার মাঝে কোনো আনন্দ নেই কিন্তু স্কুলে লেখাপড়া করতে হয়। লেখাপড়া মানেই হচ্ছে মুখস্থ, বেশি মুখস্থ কম মুখস্থ আর মাঝারি মুখস্থ, মনে হয় মুখস্থ করতে করতে একদিন জানটা বের হয়ে যাবে। আমাদের ক্লাসে শান্তা নামে একটা মেয়ে পড়ে। সে একদিন আমাকে বলল, “বুঝলি তিতু, আমার সবচেয়ে বেশি রাগ কার উপর?”
“কার উপর?”
”বেগম রোকেয়ার উপর।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “কেন?”
“বেগম রোকেয়াই তো নারী শিক্ষা নারী শিক্ষা বলে আমাদের সর্বনাশ করেছে। যদি না করতো তা হলে আমাদের লেখাপড়া করতে হত না। মুখস্থ করতে হত না। ঘরে বসে দিনরাত টিভি দেখতাম। ইস ভগবান! কী মজাই না তা হলে হত।”
শান্তা মনে হয় কথাটা ভুল বলে নাই। কিন্তু ক্লাসের মেয়েগুলো বেগম রোকেয়ার কারণেই হোক আর অন্য কারণেই হোক লেখাপড়া করতে এসে আমাদের ঝামেলা করে দিয়েছে। স্যার-ম্যাডামরা যখন যে হোমওয়ার্ক করতে দেন তারা সেগুলো ঠিকঠাক করে আনে আর সেই জন্যে আমাদের বকাবকি শুনতে হয়। বকাবকি আমি মোটামুটি সহ্য করে ফেলি কিন্তু যখন খপ করে কান ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দেন কিংবা একটা বেত দিয়ে হাতের মাঝে সপাং সপাং করে মারতে থাকেন তখন সেটা সহ্য করতে পারি না, যতটুকু ব্যথা লাগে তার থেকে বেশি লাগে অপমান।
আমাদের স্কুলের বিল্ডিংটা অনেক বড়, অনেক ক্লাস রুম, অফিস, সামনে বড় মাঠ কিন্তু কোনোখানে কোনো আনন্দ নেই। একটা বড় লাইব্রেরি আছে কিন্তু সেটা সবসময় তালা মারা থাকে। জানালার ফাঁক দিয়ে আমরা মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখি, সারি সারি আলমারি বোঝাই বই, কিন্তু আমরা কোনোদিন সেই আলমারির বইগুলি ছুঁয়েও দেখতে পারিনি। একদিন আমি সাহস করে আমাদের বাংলা স্যারকে বললাম, “স্যার। আমাদের লাইব্রেরিতে আমরা যেতে পারি না স্যার?”
স্যার বললেন, “কী বললি?”
আমি আমতা আমতা করে বললাম, “লাইব্রেরি”
“লাইব্রেরি? কী হয়েছে লাইব্রেরির?”
“আমরা লাইব্রেরিতে যেতে পারি না স্যার?”
স্যার অবাক হয়ে বললেন, “কেন? লাইব্রেরিতে কেন যাবি?”
“বই পড়তে।”
“বই পড়তে? পড়ার বই নাই? তোর পাঠ্য বই নাই? গাইড বই নাই?”
“আছে স্যার। কিন্তু লাইব্রেরি থেকে অন্য বই পড়তে চাচ্ছিলাম।”
স্যার চোখ পাকিয়ে বললেন, “আউট বই? আউল-ফাউল বই?”
মামুন তখন আমাকে সাহায্য করার জন্যে বলল, “অন্য বইও পড়া যায় স্যার। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই। মহাকাশের বই।”
আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে চালাক-চতুর মেয়ে হচ্ছে রিতু, সে বলল, “কাজী নজরুল ইসলাম-রবীন্দ্রনাথের বইও পড়া যায়।“
বাংলা স্যার তো আর কাজী নজরুল ইসলাম আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়ে বাজে কথা বলতে পারেন না, তাই মুখ শক্ত করে বললেন, “তোদেরকে লাইব্রেরিতে ঢুকতে দেই আর তোরা বই চুরি করে লাইব্রেরিটা শেষ করে দিস?”
আমি বললাম, “কেন স্যার? বই চুরি করব কেন?” শান্তা বলল, “আমরা বই পড়ব।”
“আমি তোদের খুব ভালো করে চিনি, তোরা হচ্ছিস পাজি বদমাইশ আর চোর। সবাই একজন করে চোর। কেউ ছোট চোর কেউ বড় চোর। সুযোগ পেলেই তোরা বই চুরি করবি।”
স্যারের কথা শুনে আমার খুবই রাগ হল, আমি বললাম, “যদি আমাদেরকে লাইব্রেরিতে ঢুকতে না দেন তা হলে স্কুলে লাইব্রেরিটা আছে কেন?”
স্যার একটু থতমত খেয়ে গেলেন, তারপর প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললেন, “যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা? আমার তোকে কৈফিয়ত দিতে হবে লাইব্রেরিটা কেন আছে?”