তারপর সে মুখস্থ বলে যেতে থাকে, “মহাকর্ষ বল ভর দুটির গুণফলের সমানুপাতিক এবং দুইটি ভরের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। উল্লেখ্য যে, মহাকর্ষ বল সার্বিকভাবে সংজ্ঞায়িত করার জন্যে একটি ধ্রুবক ব্যবহার করা হইয়াছে। এম কে এস পদ্ধতিতে এই ধ্রুবকের মান ছয় দশমিক ছয় সাত চার গুণন দশ ঊর্ধ্বঘাত ঋণাত্মক এগারো…”
ক্লাসের পড়া করার জন্যে আমাকেও মুখস্থ করতে হয় কিন্তু ভাইয়ার মতো দাড়ি কমাসহ মুখস্থ করতে আমি কাউকে দেখিনি। এই ব্যাপারটাতে সে মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এক্সপার্ট। আমার আব্বু আর আম্মু এখন ভাইয়ার উপরে খুব খুশি। বাসায় কেউ বেড়াতে এলেই আবু-আম্মু টিটুকে দেখিয়ে বলেন, “এই যে টিটু, আমাদের বড় ছেলে। লেখাপড়ায় খুব মনোযোগ। সামনের বার এসএসসি দিবে। পরীক্ষার এখনো দেড় বছর বাকি, এর মাঝে সারা বই মুখস্থ করে ফেলেছে।”
ভাইয়ার মুখে তখন অহংকারের একটা হাসি ফুটে ওঠে, সে তখন তার কুঁজো ঘাড়টা সোজা করার চেষ্টা করে। আমি সবসময় দূরে থাকার চেষ্টা করি, কিন্তু মাঝে মাঝেই আমাকে ডেকে আনা হয়। সামনে আসার পর আল্লু না হয় আম্মু দুজনেই হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলেন, “এই যে আমাদের ছোট ছেলে তিতু। পড়ালেখায় মনোযোগ নাই। বড় ভাইকে দেখেও কিছু শিখল না।”
যারা বেড়াতে আসেন তাদের মাঝে এক দুইজন ভালো মানুষ থাকে, তারা বলে, “আরে কী বলেন আপনি। কী ব্রাইট চেহারা তিতুর, দেখবেন একটু বড় হলেই ঠিক হয়ে যাবে।”
অন্য কেউ কিছু বলার আগেই ভাইয়া বলে, “হবে না। আমি টেস্ট করেছি।”
“কী টেস্ট করেছ?”
“তিতু মুখস্থ করতে পারে না। যেমন মনে করেন একটা আস্ত পৃষ্ঠা মুখস্থ করতে আমার লাগে তেতাল্লিশ মিনিট। তিতু তিন ঘন্টাতেও পারে না। প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলে।”
সবাই তখন দুশ্চিন্তায় মাথা নাড়ে। আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকি। শুধু যে বাসায় কেউ বেড়াতে এলে আমাকে অপমান করা হয় তা নয়, এমনিতেই ভাইয়া সারাক্ষণ আমাকে অপমান করে যাচ্ছে। বন্ধুর কাছ থেকে হয়তো একটা ফাটাফাটি ডিটেকটিভ বই এনেছি, রাতে বসে বসে পড়ছি ওমনি ভাইয়া নাকি সুরে নালিশ করে দেবে, “আঁম্মু, তিঁতা আঁউট বঁই পড়ছে?” আম্মু এসে বইটা কেড়ে নেবেন। আমি হয়তো একটা অঙ্ক করার চেষ্টা করছি ওমনি ভাইয়া নালিশ করে দেবে, “আঁম্মু তিঁতা পঁড়ছে নাঁ।” আম্মু এসে চোখ পাকিয়ে বলবেন, “কী করছিস তিতু?”
আমি ভয়ে ভয়ে বলি, “অঙ্ক করছি।”
আম্মু বলেন, “অঙ্ক করার কী আছে? সময় নষ্ট করে লাভ কী? নোট বইয়ে সব অঙ্ক করে দেওয়া আছে। দেখে নে। এত টাকা দিয়ে নোট বই কিনে দিলাম কেন?”
তারপরেও মাঝে মাঝে বলি, “নিজে নিজে করতে চাচ্ছিলাম-”
“নিজে নিজে? নিজে নিজে করার কী আছে? তুই কি মনে করিস যারা এই নোট বইটা লিখেছে তুই তাদের থেকে বেশি জানিস?”
আমি মাথা নেড়ে স্বীকার করলাম যে আমি বেশি জানি না। নোট বইটা লিখেছে একজন এক্সপার্ট হেড মাস্টার, আমি এক্সপার্ট হেড মাস্টার থেকে বেশি কেমন করে জানব?
তবে হেড মাস্টাররা যে সবসময় বেশি জানে সেইটা সত্যি নাও হতে পারে। আমাদের স্কুলের যে হেড মাস্টার আছেন সেই মানুষটা খুব বেশি জানেন বলে মনে হয় না। একদিন আমাদের বিজ্ঞান ক্লাস নিচ্ছেন তখন মামুন জিজ্ঞেস করল, “স্যার, জলবিদ্যুৎ কেমন করে তৈরি করে?” মামুন হচ্ছে আমাদের ক্লাস সায়েন্টিস্ট। সে সবসময় সবাইকে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করে।
হেড মাস্টার তার দাড়ির মাঝে আঙুল চালিয়ে সেগুলো সোজা করতে করতে বললেন, “জল দিয়ে। অ্যাঁ জল মানে হচ্ছে অ্যাঁ পানি। হিন্দুরা বলে অ্যাঁ জল আমরা বলি অ্যাঁ পানি।” কথার মাঝে অ্যাঁ অ্যাঁ বলা স্যারের অভ্যাস।
“কিন্তু স্যার পানি দিয়ে ইলেকট্রিসিটি কেমন করে তৈরি হয়!”
হেড স্যার বললেন, “এইটাও জানিস না গাধা? অ্যাঁ?”
মামুন মাথা নাড়ল, “না স্যার।”
“উপর থেকে অ্যাঁ যদি পানি ফেলা হয় তখন আমরা অ্যাঁ কী দেখি? অ্যাঁ? আমরা দেখি অ্যাঁ স্পার্ক। পার্কটাই হচ্ছে বিদ্যুৎ। অ্যাঁ।”
মামুন ইতস্তত করে বলল, “কিন্তু স্যার আমরা তো পানি ফেললে স্পার্ক দেখি না।”
হেড স্যার খ্যাক করে উঠলেন, “দেখি না মানে? অ্যাঁ অ্যাঁ? যখন ঝড়বৃষ্টি হয় তখন কোনোদিন অ্যাঁ বিজলি চমকাতে দেখিসনি অ্যাঁ? সেই একই ব্যাপার। অ্যাঁ। বুঝেছিস গাধা কোথাকার?”
মামুন কিছু বুঝে নাই আমরাও কেউ কিছু বুঝি নাই কিন্তু সেটা কারো বলার সাহস হল না। সবাই মাথা নেড়ে ভান করলাম যে বুঝেছি। তার কয়েকদিন পরে আমাদের স্কুলে একটা অনুষ্ঠানের জন্যে একটা জেনারেটর এনেছে সেটা ভটভট করে বিকট শব্দ করে চলছিল, একজন মানুষ সেখানে কাজ করছিল, মামুন তাকে জিজ্ঞেস করল, “এইটা কী?”
মানুষটা বলল, “এইটা জেনারেটর।”
“এইটা দিয়ে কী করে?”
“ইলেকট্রিসিটি তৈরি করে।”
মামুন জ্ঞানী মানুষের মতো বলল, “জলবিদ্যুৎ তৈরি করলেই তো এইরকম ভটভট শব্দ করত না। ওপর থেকে পানি ফেললেই ইলেকট্রিসিটি তৈরি হত।”
শুনে মানুষটা খ্যাক খ্যাক করে হাসতে থাকে। মামুন গরম হয়ে বলল, “আপনি হাসেন কেন?”
“তোমার কথা শুনে।”
“আমি কী বলেছি?”
“তুমি বলেছ যে পানি ঢাললে ইলেকট্রিসিটি হয়। তা হলে তুমি যখন পিশাব করবে তখন সাবধান! অসুবিধা জায়গায় ইলেকট্রিক শক না খেয়ে যাও। হা হা। হা।” মানুষটা দাঁত বের করে হাসতেই থাকে।