সুজন বলল, “রাস্তায় একটা মানিব্যাগ পড়ে ছিল, তোলার আগেই আরেকজন তুলে নিল। ইস!”
রিতু চোখ পাকিয়ে বলল, “তোর মানিব্যাগের খেতাপুড়ি। এখন ফিরে যাব কেমন করে?”
মামুন বলল, “হেঁটে। আবার কীভাবে?”
আমি দূরে মানুষের জটলার দিকে তাকিয়ে বললাম, “মারামারি কি বন্ধ হয়েছে?”
আঁখি বলল, “হ্যাঁ বন্ধ হয়েছে।”
আমরা চোখ দিয়ে দেখে যেটা বুঝতে পারি না আঁখি কান দিয়ে শুনে সেটা বুঝে ফেলে। আমি বললাম, “চল তা হলে যাই।”
ঠিক যখন রওনা দিব তখন একটা পুলিশের গাড়ি এসে থামল, অনেকগুলো পুলিশ সেখান থেকে নেমে আমাদের দিকে ছুটে আসে। সবার সামনে পাহাড়ের মতো বড় একজন পুলিশ, হাত-পা নেড়ে চিৎকার করে বলল, “এই! এই পোলাপান! তোমরা এইখানে কী কর?”
আমরা কিছু বলার আগেই আরেকজন বলল, “কথা বলার দরকার নাই। লাঠি দিয়া দুইটা বাড়ি দেন।”
একজন সত্যি সত্যি মোটা একটা লাঠি নিয়ে এগিয়ে এল, তখন আরেকজন থামিয়ে বলল, “দাঁড়াও। এরা কী করে এইখানে? আমরা যেখানে থাকার সাহস পাই না সেখানে এরা কী করে?”
একজন সুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, “এটাই হচ্ছে পালের গোদা। বদমাইশ। আমি দেখেছি এইটা ঢিল ছুড়ছে।”
সুজন মিনমিন করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তখন পাহাড়ের মতো পুলিশটা ধমক দিয়ে বলল, “চুপ কর বদমাইশ। মাথা ভেঙে ফেলব।”
রিতু এতো সুন্দর করে কথা বলতে পারে সে একটু চেষ্টা করল কিন্তু পাহাড়ের মতো লোকটা ধমক দিয়ে তাকেও থামিয়ে দিয়ে বলল, “সবগুলোর কোমরে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাই। এক রাত হাজতে থাকুক তারপর চালান দিয়ে দিব। তখন বুঝবে মজা।”
আরেকজন বলল, “বাপ-মায়েরও একটু শিক্ষা হওয়া দরকার। ছেলেপিলেরে মানুষ করতে পারে না, একেকটা বড় হচ্ছে যেন ইবলিসের বাচ্চা হয়ে।”
রিতু আরেকবার কথা বলার চেষ্টা করল, মানুষটা চিৎকার করে বলল, “খবরদার একটা কথা না। গাড়িতে উঠ।”
আমরা কিছু বলার সুযোগ পেলাম না, পুলিশগুলো ধাক্কা দিয়ে আমাদেরকে পুলিশ ভ্যানের পিছনে তুলে নিল। বেচারি আঁখি কোথায় কোনদিকে যাচ্ছে বুঝতে না পেরে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল, তখন পাহাড়ের মতো মানুষটা খেঁকিয়ে উঠল, “কানা না কি? চোখে দেখতে পাও না?”
আঁখি কিছু বলল না।
ভ্যানের পিছনে তোলার পর দুইজন আমাদের পাশে বসল। তখন গাড়িটা ছেড়ে দিল। আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে। বলেছে হাজতে নিয়ে রাখবে, তারপরে না কি চালান দিবে। কেমন করে চালান দেয়? কোথায় চালান দেয়? যখন সবাই খবর পাবে যে পুলিশ আমাদের অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে তখন তারা কী করবে? আব্বু আম্মু কী করবেন? নতুন ম্যাডাম কী করবেন? আমাদের নিশ্চয়ই টি সি দিয়ে স্কুল থেকে বের করে দিবে। তখন আমি কী করব? অন্যেরা কী করবে?
চিন্তা করে যখন কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছি না তখন শুনলাম সুজন ফিসফিস করে বলছে, “পালাতে হবে।”
আমি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, “পালাতে হবে?”
“হ্যাঁ।”
“কেমন করে?”
“যখন গাড়িটা থামবে, তখন লাফিয়ে নামব। তারপর দৌড়।”
“আঁখি? আঁখি কী করবে?”
“আঁখিও দৌড়াবে।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “কেমন করে?”
“একজনকে ধরে।” আমি বুঝতে পারলাম না সেটা কেমন করে সম্ভব। কিন্তু দেখা গেল সুজন ফিসফিস করে সবাইকে এই কথাই বলে দিচ্ছে। আঁখিকেও বলা হল এবং আমি দেখলাম সেটা শুনে সে কেমন যেন চমকে উঠল। তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে উঠল কিন্তু সে আপত্তি করল না। আমরা ফিসফিস করে কথা বলছি সেটা হঠাৎ করে পাহাড়ের মতো পুলিশটা লক্ষ করল, সাথে সাথে সে খেঁকিয়ে ওঠে, “কী হচ্ছে এইখানে? গুজগুজ ফুসফুস কীসের? এক বাড়ি দিয়ে মুখ ভেঙে ফেলব।”
কাজেই আমরা সবাই চুপ করে গেলাম। গাড়ি করে আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তখনো বুঝতে পারছি না হঠাৎ সেটা থেমে গেল। তাকিয়ে দেখলাম রাস্তার পাশে কয়েকজন পুলিশ অফিসার, একজন হাত তুলে গাড়িটা থামিয়েছেন। এখন আমাদের লাফ দিয়ে নামতে হবে তারপর দৌড় দিতে হবে। আঁখির হাতে ভাজ করা লাঠিটা সে ছেড়ে দিল, সাথে সাথে সেটা লম্বা হয়ে যায়, সেটা হাতে নিয়ে সে শক্ত হয়ে বসে থাকে। পুলিশ অফিসারটি গাড়ির পিছনে দাঁড়িয়ে ভিতরে তাকালেন। পাহাড়ের মতো পুলিশটি নেমে অফিসারকে একটা সেলুট দিল। অন্যজনও হাড়পাঁচড় করে নেমে পড়ে। পুলিশ অফিসারটি আমাদের দিকে তাকালেন, তারপর একটু অবাক হয়ে পাহাড়ের মতো পুলিশটাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এরা কারা?”
পাহাড়ের মতো পুলিশটা বলল, “স্পটে ধরা পড়েছে। ঢিল ছুড়ছিল।”
অফিসারটা আঁখির দিকে তাকালেন, তার হাতের সাদা লাঠিটার দিকে তাকালেন। তারপর সুজনের দিকে তাকালেন তারপর তার অন্ধ ফকিরের মতো সানগ্লাসের দিকে তাকালেন তারপর আমাদের দিকে তাকালেন, তারপর পাহাড়ের মতো পুলিশটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি কি জান এরা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বাচ্চা?”
পাহাড়ের মতো পুলিশটা বলল, “জে?”
“ঐ মেয়েটার হাতে সাদা লাঠিটা দেখেছ? দ্য হোয়াইট কেইন? তুমি কি জান পৃথিবীর অন্য যে কোনো দেশে ঐ সাদা লাঠিটা দেখামাত্র পুরো সিস্টেম তাকে সাহায্য করার জন্যে এলার্ট হয়ে যায়? তার যেন কোনো অসুবিধা না হয় সেই জন্যে সবাই এগিয়ে আসে। আর এই আনফচুনেট দেশে তুমি তাদেরকে মিসক্রিয়েন্ট বলে ধরে নিয়ে যাচ্ছ?” পুলিশ অফিসারটি ধমক দিয়ে বললেন, “আর ইউ ক্রেজি? আর ইউ স্টুপিড?”