রিতু জানতে চাইল, “কেন?”
“যে মানুষটা ওষুধ বিক্রি করছে তার চেহারাটা ভালো না।”
একজন মানুষের চেহারা ভালো না হলে তার থেকে ওষুধ কেনা যাবে না এরকম যুক্তি এর আগে কেউ কখনো দিয়েছে বলে মনে হয় না কিন্তু আমরা যুক্তিটা মেনে নিলাম। এর পরে বড় একটা জেনারেল স্টোর ধরনের দোকান পাওয়া গেল যেটা দেখে সুজনের খিদে পেয়ে গেল। আমরা তখন টাকা-পয়সা ভাগাভাগি করে দুইটা চিপসের প্যাকেট কিনলাম-এখানেও সুজন খারাপভাবে দরদাম করল। এবারে অবশ্যি কোনো লাভ হল না, মানুষটা রেগেমেগে আমাদের ফ্রি দিয়ে দিল না। আমরা চিপস খেতে খেতে হাঁটতে থাকি তখন আরেকটা ফার্মেসি পেলাম, সেটা রাস্তার অন্যপাশে কাজেই সেখানে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তখন মামুন বলল আমরা যদি এক কিলোমিটার হাঁটতে রাজি থাকি তা হলে শহরের সবচেয়ে বড় ফার্মেসি থেকে ওষুধটা কিনতে পারব। আমরা রাজি হয়ে হাঁটতে লাগলাম তখন মামুন রিকশা করে যাওয়ার প্রস্তাব দিল। আমরা তখন আবার টাকা-পয়সা ভাগাভাগি করে দেখলাম যে ইচ্ছে করলে রিকশা করে যেতে পারি।
আমরা তখন দরদাম করে দুইটা রিকশা ভাড়া করলাম, একটা রিকশায় উঠল রিতু আর আঁখি অন্যটাতে আমি মামুন আর সুজন। আমরা গল্প করতে করতে যাচ্ছি, ফাঁকা রাস্তায় রিকশা গুলির মতোন ছুটছে। হঠাৎ করে সামনের রিকশাটি থেমে গেল আর সেখান থেকে রিতু আমাদের চিৎকার করে ডাকল। আমরা আমাদের রিকশা থেকে নেমে রিতুর কাছে গেলাম। রিতু বলল, “আঁখি বলছে। অবস্থা ভালো না।”
আমরা জিজ্ঞেস করলাম, “কার অবস্থা ভালো না?”
আঁখি বলল, “এই এলাকার।”
“কী হয়েছে এই এলাকার?”
“কোনো একটা গোলমাল হয়েছে এখানে।”
“গোলমাল?” আমরা অবাক হয়ে চারিদিকে তাকালাম এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম আঁখি সত্যি কথা বলছে। এটা মোটামুটি বড় রাস্তা। অনেক গাড়ি যাবার কথা কিন্তু এখন কোথাও কিছু নেই। দোকানপাট বন্ধ এবং মানুষজন এদিকে-সেদিকে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং চিন্তিত মুখে কথা বলছে। দূরে অনেকগুলো পুলিশ।
আমি বললাম, “চল ফিরে যাই।”
সুজন বলল, “আগে দেখি কী হয়েছে।”
আমরা কিছু বলার আগে হঠাৎ করে কোথা থেকে অনেকগুলো মানুষ হইচই করতে করতে ছুটে আসতে থাকে, তাদের হাতে লাঠিসোটা।”একশান একশান ডাইরেক্ট একশান” বলতে বলতে তারা ঢিল ছুঁড়তে ছুঁড়তে একদিক থেকে এগিয়ে আসতে থাকে এবং অন্যদিক থেকে পুলিশ তাদের দিকে ছুটে আসতে থাকে। পুলিশ আর এই মানুষগুলো দেখতে দেখতে একদল আরেকদলের ওপর চড়াও হল এবং প্রচণ্ড মারামারি শুরু হয়ে গেল। আমরা ঠিক মাঝখানে রিতু আর আঁখি রিকশা থেকে নেমে পড়ে আর আমরা প্রাণপণে ছুটতে থাকি। ছুটতে ছুটতে আঁখি রাস্তায় আছড়ে পড়ল, মানুষজন তার ওপর দিয়ে ছুটতে থাকে পুলিশ লাঠি দিয়ে লোকজনকে পেটাতে থাকে। আমি কোনোমতে আঁখির কাছে ছুটে গেলাম, তাকে টেনে দাঁড়া করিয়ে অন্যদের খুঁজতে লাগলাম, কাউকে দেখতে পেলাম না। আঁখির চোখে-মুখে আতঙ্ক, সে আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। আমার মনে হল দূরে গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। মানুষ আর্তনাদ করতে লাগল এবং তার মাঝে কয়েকটা বিস্ফোরণ হল। ক্যামেরা নিয়ে সাংবাদিকেরা ছোটাছুটি করছে এবং ছবি তুলছে। আমি আঁখিকে ধরে দৌড়াতে লাগলাম এবং মনে হল তখন সাংবাদিকেরা আমাদের ছবি তুলতে শুরু করেছে।
একটা দোকানের বন্ধ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আমি অন্যদের খুঁজলাম, আশেপাশে কেউ নেই কে কোন দিকে গিয়েছে জানি না। রাস্তায় একজন মানুষ পড়ে আছে, মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। অন্য একজন মানুষ ভয়ে পুলিশের দিকে তাকাচ্ছে। পুলিশ তাকে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে পিটাতে থাকে।
হঠাৎ করে চারপাশে একটু ফাঁকা হয়ে যায় এবং শিলাবৃষ্টির মত ঢিল পড়তে থাকে। ঠিক আমার কানের কাছে দিয়ে বড় একটা ঢিল উড়ে গিয়ে নিচে পড়ে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেল। আমি আতঙ্কিত হয়ে তাকালাম–দূর থেকে অনেক মানুষ ঢিল ছুড়ছে, এর যে কোনো একটা ঢিল মাথায় লাগলে মাথা ফেটে ঘিলু বের হয়ে যাবে। আমি দূর থেকে উড়ে আসা ঢিলগুলো দেখতে পাই, একটু সরে যেতে পারি কিন্তু আঁখি তো পারবে না-সে তো কিছু দেখছে না।
“আঁখি!”
“কী?”
“তুই আমাকে ধরে থাকিস–আমি যেদিকে সরি তুই সেদিকে সরে যাবি।”
আঁখি কাঁপা গলায় বলল, “ঠিক আছে।”
ঠিক তখন একটা গাড়ি সাইরেন বাজাতে বাজাতে গেল, আর দূরের মানুষগুলো আরো দূরে সরে গেল। ঢিল একটু কমে এল আর আমি রিতুকে দেখতে পেলাম, সে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে আমাদের কাছে ছুটে এল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”
“পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি।”
আঁখি জিজ্ঞেস করল, “বেশি?”
“না। ঠিক হয়ে যাবে।”
আমরা তখন আমাদের বাকি দুজনকে দেখতে পেলাম, তারাও দৌড়ে আমার কাছে এল, সুজনের চোখে একটা ঢলঢলে সানগ্লাস। আমাদের দেখিয়ে বলল, “দেখেছিস? রাস্তায় পেয়েছি, ফাটাফাটি সানগ্লাস।”
আমার বিশ্বাস হল না এরকম সময়ে কেউ রাস্তা থেকে কুড়িয়ে একটা সানগ্লাস তুলে নিতে পারে। সানগ্লাসটা ফাটাফাটি হতে পারে কিন্তু সেটা পরার পর সুজনকে দেখাচ্ছে অদ্ভুত! আমাদের রাস্তার মোড়ে একজন অন্ধ ফকির ভিক্ষে করে, বসন্ত হয়ে তার চোখ নষ্ট হয়ে গেছে, সে এরকম একটা সানগ্লাস পরে থাকে। সুজনকে আমি সেটা এখন আর বললাম না, সেটা বলার সময়ও এটা না, এখন আমাদের কোটি টাকার প্রশ্ন আমরা কেমন করে স্কুলে ফিরে যাব। এরকম ভয়ংকর মারামারির মাঝে হাজির হওয়ার খবরটা বাসায় কিংবা স্কুলে পৌঁছে গেলে আমাদের কপালে দুঃখ আছে। সাংবাদিকেরা আমাদের ছবি তুলছিল, যদি সেই ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়ে যায় তা হলে কী হবে? আমাদের কথা ছেড়ে দিলাম, এরকম একটা জায়গায় আমরা আঁখিকে টেনে নিয়ে এসেছি সেটা যখন স্যার ম্যাডাম জানতে পারবেন তখন কী হবে? মাত্র এক সপ্তাহ আগে নতুন ম্যাডাম বলেছেন আমরা যেন আঁখিকে ভালো করে দেখেশুনে রাখি-এটা কি দেখেশুনে রাখার নমুনা? যদি একটা ঢিল এসে আঁখির গায়ে লাগত তা হলে কী হত?