রিতু বলল, “সুমির ওষুধ কিনতে।”
“এতো জন?”
“সমস্যা কী? এই তো রাস্তার ওপাশে ফার্মেসি। যাব আর আসব।”
“আমিও যাব।”
সুজন মুখ ভেংচে বলল, “তুই একা কেন? আরো চৌদ্দজনকে গিয়ে ডেকে নিয়ে আয়! তারপর সবাই মিলে মিছিল করতে করতে যাই!”
রিতু বলল, “আমি স্লোগান দিয়ে বলব, যাচ্ছি কোথায় যাচ্ছি কোথায়। সবাই বলবে সুমির ওষুধ কিনতে! সুমির ওষুধ কিনতে!”
মামুন মুখ শক্ত করে বলল, “আমি সাথে গেলে তোদর সমস্যা আছে?”
আমি বললাম, “নাই।”
“তা হলে চল।”
কাজেই আমরা পাঁচজন গেটে হাজির হলাম। দারোয়ান ভুরু কুঁচকে বলল, “কী চাও?”
রিতু বলল, “বাইরে যাব।”
“বাইরে যাবে? কেন?”
“আমাদের এক ফ্রেন্ডের জন্যে ওষুধ কিনতে। খুব সিরিয়াস অবস্থা।”
“কী হয়েছে?”
“এলার্জি।”
“সেটা কী?”
সুজন বলল, “খুব ভয়ংকর অসুখ। সারা শরীরে চাকা চাকা লাল দাগ। চোখ-মুখ ফুলে গেছে। নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।”
এই হচ্ছে সুজনের কথা বলার ধরন। যেখানে সত্যি কথা বললেই কাজ হয় সেখানেও মিথ্যা কথা বলে ফেলে। দারোয়ান সুজনের কথা বিশ্বাস করল বলে মনে হয় না, মুখ শক্ত করে বলল, “টিফিনের ছুটিতে কোনো ছেলেমেয়ের বের হবার পারমিশান নাই।”
সুজন চোখ লাল করে বলল, “আপনি চান আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যাক?”
মারা যাবার কথা শুনেও দারোয়ানের কোনো ভাবান্তর হল না। সে একটা হাই তুলে ম্যাচের কাঠি দিয়ে দাঁত খুঁটতে খুঁটতে বলল, “সেইটার দায়িত্ব আমার না। আমার দায়িত্ব গেট খোলা আর গেট বন্ধ করা।”
সুজন গরম হয়ে বলল, “আমার কথা বিশ্বাস না করলে জালাল স্যারকে জিজ্ঞেস করেন।”
আমাদের অঙ্ক স্যারের নাম জালালউদ্দিন, স্কুলে এই স্যারকে সবাই গুরুত্ব দেয়। দারোয়ানও গুরুত্ব দিল, পকেট থেকে তার মোবাইল টেলিফোন বের করে সে কোনো একটা নম্বরে ডায়াল করল, অন্য পাশে ফোন ধরার পর বলল, “স্যার কিছু ছেলেমেয়ে বলছে তাদের না কি ওষুধ কিনার জন্যে বাইরে যাওয়া দরকার”
দারোয়ানের কথা শেষ হবার আগেই স্যার নিশ্চয়ই সেটা সত্যি বলে জানিয়েছেন। কাজেই দারোয়ান খুবই বিরস মুখে টেলিফোনটা পকেটে রাখল। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে গেটের ছিটকানি খুলে আমাদের বের হতে দিল। সুজন মুখ শক্ত করে বলল, “আপনার জন্যে আমাদের দেরি হল। যদি সুমির কিছু হয় তা হলে কিন্তু আপনি দায়ী থাকবেন।”
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজে দেরি হয়ে গেলে চোখে-মুখে যেরকম গম্ভীর ভাব রাখতে হয় আমরা সেরকম গম্ভীর ভাব করে গেট দিয়ে বের হলাম। বের হবার পরই অবশ্যি আমাদের মুখে হাসি ফুটে উঠল। আমরা রাস্তাটা পার হয়ে ফার্মেসিতে ঢুকলাম। ফার্মেসির মানুষটা একটা খবরের কাগজ পড়ছে, আমাদের দেখে চোখ তুলে তাকাল। সুমির ওষুধটার নাম কাগজে লিখে এনেছিলাম সেটা মানুষটার হাতে দিয়ে বললাম, “এইটা আছে?”
মানুষটা দেখে বলল, “আছে। কয়টা নিবে?”
সুজন জিজ্ঞেস করল, “দাম কত?”
“এক পাতা দুই টাকা।”
এক পাতায় অনেকগুলো ট্যাবলেট থাকে, এতোগুলো ট্যাবলেটের দাম মাত্র দুই টাকা। আমি পকেট থেকে টাকা বের করছিলাম কিন্তু সুজনের কথা শুনে থেমে গেলাম। সে দরদাম শুরু করে দিল, “কম করে বলেন। এক টাকা।”
মানুষটা সুজনের কথা শুনে কেমন যেন অবাক হয়ে গেল, জিজ্ঞেস করল, “এক টাকা?”
“হ্যাঁ। এক টাকা।”
মানুষটা খবরের কাগজটা ভাঁজ করে রেখে আলমারি খুলে একটা ওষুধের বাক্স থেকে এক পাতা ট্যাবলেট বের করে কেমন যেন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিল। আমি পকেট থেকে টাকা বের করলাম, লোকটা বলল, “টাকা দিতে হবে না। যাও। এক পাতা ওষুধের জন্যে যে দুই টাকা দিতে পারে না তার কাছ থেকে আমার টাকা নিতে হবে না। তোমার দুই টাকার জন্যে আমার লাল বাতি জ্বলবে না।”
আমার অসম্ভব অপমান হল, কিন্তু সুজনের কোনোই ভাবান্তর হল না। সে ট্যাবলেটের পাতাটা নিয়ে আমাদেরকে বলল, “চল।”
আমরা ফার্মেসি থেকে বের হয়ে এলাম, রিতু বলল, “কী লজ্জা। কী লজ্জা।” সু
জন বলল, “লজ্জার কী আছে?”
আমি রেগে বললাম, “লজ্জার কী আছে তুই বুঝিসনি। গাধা কোথাকার? আমরা কী ফকির না কি যে ভিক্ষে দেবে।”
মামুন বলল, “ওষুধের ডেট নিশ্চয়ই শেষ, ফেলে না দিয়ে আমাদেরকে দিয়ে দিয়েছে।”
আমরা তখন ট্যাবলেটের পাতাটা ওলটপালট করে দেখার চেষ্টা করলাম কোথাও তারিখ দেওয়া আছে কি না। তারিখ দেওয়া নেই তাই বোঝা গেল না বাতিল হয়ে যাওয়া ওষুধ আমাদের ধরিয়ে দিয়েছে কি না। আঁখি বলল, “বাতিল ওষুধ না। ওষুধ ঠিকই আছে।”
রিতু বলল, “তুই কেমন করে জানিস?” প্রথম প্রথম কয়েকদিন ভদ্রতা করে আঁখির সাথে সবাই তুমি করে কথা বলেছে এখন আমরা তুইয়ে নেমে এসেছি।
আঁখি বলল, “না জানার কী আছে? দুই টাকার ওষুধ ফ্রি দেওয়ার জন্যে বাতিল ওষুধ খুঁজতে হয় না।”
আমি বললাম, “চল তা হলে যাই।”
সুজনকে স্কুলে ফিরে যাবার ব্যাপারে খুব উৎসাহী দেখা গেল না। সে বলল, “আয় আরেকটা ফার্মেসি দেখে যাই।”
ওষুধটা যেহেতু হয়েই গেছে এখন স্কুলে ফিরে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ কিন্তু ঠিক কী কারণ জানা নেই আমরা সবাই সুজনের কথায় রাজি হয়ে গেলাম। পাঁচজন মিলে কথা বলতে বলতে হাসাহাসি করতে করতে হাঁটতে থাকি। পরের ফার্মেসির সামনে দাঁড়িয়ে ভিতরে উঁকি দিয়ে সুজন বলল, “নাহ্। এখান থেকে ওষুধ কেনা যাবে না।”