আমি হাত তুলে বললাম, “ম্যাডাম।”
“বল।”
“আপনি যেগুলো বলেছেন তার কোনোটাই আমাদের নাই কিন্তু একটা আছে।”
“কোনটা আছে?”
“পাখি। আমাদের এখানে পাখি আসে, আর আঁখি সবসময় তাদের খেতে দেয়।”
“সত্যি?”
আঁখি একটু হেসে বলল, “জি ম্যাডাম।”
“কী পাখি জান?”
“আগে একটা ফিঙে আসত তার দুইটা বাচ্চা নিয়ে। এখন কয়েকটা চড়াই পাখিও আসে। দুপুরের দিকে তিনটা শালিক পাখি আসে।
“বাহ!” ম্যাডাম খুশি হয়ে বললেন, “কী সুইট!”
রিতু বলল, “আস্তে আস্তে অন্যগুলোও হয়ে যাবে ম্যাডাম। আপনি দেখবেন–”
“নিশ্চয়ই হবে। ক্লাস রুমটা অন্যরকম হতে একটু সময় লাগলে ক্ষতি নেই কিন্তু আমাদের–আই মিন শিক্ষকদের সবার আগে অন্যরকম হতে হবে! সেটা যতক্ষণ না হবে ততক্ষণ লাভ নেই।”
আমাদের ভূগোল পড়ানোর কথা ছিল কিন্তু ম্যাডাম পুরো ক্লাস গল্প করে কাটিয়ে দিলেন। নানারকম গল্প–কোনো কোনোটা শুনে আমরা হেসে কুটি কুটি হলাম, কোনো কোনোটা শুনে আমাদের চোখ ছলছল করে উঠল, কোনো কোনোটা শুনে আমরা অবাক হয়ে গেলাম আবার কোনো কোনোটা শুনে রাগে আমাদের রক্ত গরম হয়ে উঠল।
যখন ক্লাসের ঘণ্টা বাজল তখন আমাদের সবার মন খারাপ হয়ে গেল। ম্যাডাম চক ডাস্টার নিয়ে যখন বের হয়ে যাচ্ছিলেন আমরা তখন বললাম, “ম্যাডাম, আপনি এখন থেকে আমাদের এই ক্লাসটা নেন। প্লীজ ম্যাডাম!”
ম্যাডাম বললেন, “এটাই নিতে পারব কী না জানি না কিন্তু কোনো একটা ক্লাস নেব। নিশ্চয়ই নেব।”
সুজন বলল, “যদি না নেন তা হলে কি হবে বুঝতে পারছেন?”
“না বুঝতে পারছি না। কী হবে?”
“আমরা সবাই দোয়া করতে থাকব যেন–”
”যেন কী?”
“যেন আমাদের অন্য সব স্যার-ম্যাডামদের বাবা মারা যেতে থাকেন!” ম্যাডাম চোখ পাকিয়ে বললেন, “দুষ্ট ছেলে!”
আমরা সবাই হি হি করে হাসতে লাগলাম। ম্যাডাম ক্লাস থেকে বের হতে হতে দাঁড়িয়ে বললেন, “তোমরা খুব একটা স্পেশাল ক্লাসে–তার কারণ এখানে স্পেশাল একজন ছাত্রী আছে। তোমরা সবাই মিলে তাকে দেখেশুনে রাখবে কিন্তু।”
আমরা সবাই একসাথে চিৎকার করে বললাম, “রাখব ম্যাডাম!”
.
এর ঠিক এক সপ্তাহ পরে ঠিক করে দেখেশুনে রাখা নিয়ে যা একটা ব্যাপার ঘটল সেটা বলার মতো নয়!
০৫-৬. মহাবিপদের মাঝে
যখন আঁখিকে দেখেশুনে রাখার কথা অথচ উল্টো তাকে নিয়ে একটা মহাবিপদের মাঝে পড়ে গেলাম
অঙ্ক ক্লাসে সুমি একটা হাঁচি দিল, হাঁচি এমন কিছু অবাক ঘটনা না–যে কেউ হাঁচি দিতে পারে। সুমির হাঁচি কিন্তু একটা অবাক ঘটনা হয়ে গেল। কারণ একটু পর সে আরেকটা হাঁচি দিল, তারপর আরেকটা তারপর আরেকটা তারপর দিতেই লাগল।
অঙ্ক স্যার বিরক্ত হয়ে বললেন, “তোর হয়েছেটা কী?”
সুমি একটা হাঁচি দিয়ে বলল, “এলার্জি।”
“কীসের এলার্জি?”
সুজন ফিসফিস করে বলল, “জ্যামিতি ক্লাসের।” কেউ সেই কথাটা শুনতে পেল না, সুমি বলল, “জানি না স্যার। আমার মাঝে মাঝে হয়।” কথা শেষ করে সুমি আরেকটা হাঁচি দিল।
অঙ্ক স্যার বললেন, “যা বাথরুম থেকে নাক ধুয়ে আয়।”
সুমি মিনমিন করে বলল, “লাভ হবে না স্যার।” তারপর আরেকটা হাঁচি দিল।
স্যার বললেন, “যা বলছি।”
কাজেই সুমি বাথরুমে নাক ধুতে গেল। কিছুক্ষণ পর সে ফিরেও এল, নাক চোখ-মুখ পানি দিয়ে ধুয়ে এসেছে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। একটু পর পর হাঁচি দিচ্ছে, নাকটা টমেটোর মতো লাল। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “হাঁচি কমে নাই?”
সুমি মাথা নাড়ল, “না স্যার।” তারপর একটা হাঁচি দিল।
”কী করবি তা হলে?”
“এলার্জির একটা ট্যাবলেট আছে সেটা খেলে কমে যাবে।”
“কোথায় সেই ট্যাবলেট?”
“ব্যাগের মাঝে থাকে। এখন আছে কি না জানি না। আবার হাঁচি।”তা হলে দেখ আছে কি না। থাকলে বের করে খা।” সুমি তার ব্যাগ আতিপাতি করে খুঁজল, ব্যাগের মাঝে নাই। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “ট্যাবলেটের নাম জানিস?”
“জানি স্যার।”
তা হলে টিফিনের ছুটিতে কাউকে পাঠিয়ে কিনে আনিস।
সুজন তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে বলল, “আমি কিনে আনব স্যার।”
স্যার সুজনের দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললেন, “একা যাবি না। সাথে আরো দুই একজনকে নিয়ে যাস।”
সুজন মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে স্যার।”
ঠিক তখন টিফিনের ঘণ্টা পড়ল। অঙ্ক স্যার বের হবার পর সুজন জিজ্ঞেস করল, “আমার সাথে কে যাবি ওষুধ কিনতে?”
আমি বললাম, “আমি।”
“আয় তা হলে।”
সুমির কাছ থেকে ওষুধের নামটা লিখে নিয়ে আমরা ক্লাস থেকে বের হলাম। যখন হেঁটে হেঁটে স্কুলের গেটের কাছে এসেছি তখন শুনলাম কে যেন পিছন থেকে ডাকছে, “এই সুজন, তিতু দাঁড়া।”
তাকিয়ে দেখি রিতু আর আঁখি। রিতু হাঁটছে তার থেকে একটু পিছনে আঁখি, রিতুর কনুইটা আস্তে করে ধরে রেখেছে, দেখে বোঝাই যায় না যে ধরে রেখেছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম”কী হল?”
“আমরাও যাব।”
“কোথায় যাবি?”
“ওষুধ কিনতে।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “ওষুধ কিনতে?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
রিতু চোখ মটকে বলল, “এমনি একটু বাইরে থেকে হেঁটে আসি।”
“আঁখিকে নিয়ে?”
“আঁখির জন্যেই তো যাচ্ছি! বাইরে থেকে হেঁটে আসি।”
“স্যার যদি জানেন?”
“স্যার জানলে সমস্যা কী? স্যারই তো সুজনকে বলেছেন কয়েকজনকে নিয়ে যেতে। আমরা হচ্ছি কয়েকজন।”
সুজন দাঁত বের করে হাসল, বলল, “চল!” যে কোনো বেআইনি কাজে সুজনের সবসময় উৎসাহ।
আমরা যখন গেটের কাছে পৌঁছে গেছি তখন মামুন আমাদের কাছে ছুটে এলো, জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাস?”