আমরা সবাই একসাথে কথা বলতে শুরু করলাম, “ম্যাডাম গোলমাল হয়েছিল”
“সর্বনাশ হয়েছিল” “বাংলা স্যার যা খারাপ খারাপ কথা বলছিলেন” “নিষ্ঠুর! নিষ্ঠুর!” “ভয়ংকর অবস্থা” “পুরা বেইজ্জতি” “কী লজ্জা!”
ম্যাডাম হাত তুলে আমাদের থামালেন, বললেন, “আমি জানি। আমি সব খবর পেয়েছি। তোমরা ব্যাপারটা যেভাবে সামলে নিয়েছ তার কোনো তুলনা নেই।”
ম্যাডামের প্রশংসা শুনে আমরা সবাই আনন্দে দাঁত বের করে হাসলাম। ম্যাডাম বললেন, “কিন্তু যদি উল্টো ব্যাপারটা ঘটত? তোমাদের স্যার ঠিকভাবে নিতেন আর তোমরা নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে?”
আমরা প্রবল বেগে মাথা নাড়লাম, “না, না ম্যাডাম, আমরা কখনোই নিষ্ঠুর হতাম না।”
ম্যাডাম বললেন, “ছোট বাচ্চারা না বুঝেই অনেক সময় নিষ্ঠুর হয়ে যায়। গরু কোরবানি দেখলে আমাদের বয়সী মানুষের ভয়ে হার্ট ফেল হয়ে যায়, দেখবে ছোট ছোট বাচ্চারা অবলীলায় গরু জবাই দেখছে।”
ম্যাডামের কথা শুনে আমরা অনেকেই মাথা নাড়লাম, আমাদের অনেকেই গরু জবাই দেখেছি, এটা দেখে যে বড় মানুষের হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায় আমরা জানতাম না। ম্যাডাম বললেন, “আমার একজন লেখক বন্ধু আছে তার খুব শখ বাচ্চাদের জন্যে বই লিখবে। সে তাই একটা বই লিখে বাচ্চাদের পড়তে দিয়েছে। পড়া শেষ হলে বাচ্চাদের কাছে জানতে চেয়েছে বইটা কেমন হয়েছে। বাচ্চারা কী বলেছে জান?”
“কী বলেছে?”
“বলেছে–এইটা আপনি কী লিখেছেন? পড়ে বমি এসে গেছে!”
আমরা সবাই হি হি করে হেসে উঠলাম। ম্যাডামও হাসলেন, একসময় হাসি থামিয়ে বললেন, “বাচ্চাদের কথা শুনে আমার সেই লেখক বন্ধু মনের দুঃখে লেখালেখিই ছেড়ে দিল।”
শান্তা বলল, “যে লেখা পড়লে বমি এসে যায় সেটা ছেড়ে দেওয়াই তো ভালো।”
ম্যাডাম মাথা নাড়লেন, “এগুলো খুবই আপেক্ষিক ব্যাপার। কোনো একটা লেখা পড়ে হয়তো একজনের বমি এসে যাচ্ছে আরেকজনের হয়তো সেই লেখাটাই খুব ভালো লাগবে। তবে সেটি কথা নয়, কথা হচ্ছে এভাবে সেটা সোজাসুজি বলে ফেলাটা। শুধুমাত্র একটা ছোট বাচ্চাই এরকম নিষ্ঠুরের মতো সত্য কথা বলতে পারে। বড়রা পারে না। বড়রা সবসময় ভদ্রতা করে মিষ্টি করে কথা বলে।”
এরকম সময় আঁখি হাত তুলল, ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন, “আঁখি, তুমি কিছু বলবে?”
“জি ম্যাডাম।”
“বল।”
“আপনারা সবাই আমাকে নিয়ে কথা বলছেন। তা হলে কী আমাকে একটু জিজ্ঞেস করবেন না আমি ভালো আছি না খারাপ আছি? হয়তো আমি খুবই খুবই খারাপ আছি, হয়তো এরা সবাই আমাকে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা জ্বালাতন করে, হয়তো আমার জান খারাপ করে দেয়, হয়তো আমার টিফিন চুরি করে খেয়ে ফেলে-”
ম্যাডাম একটু এগিয়ে এসে আঁখির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “খায় না কি?”
“এখনো খায় নাই।”
“তা হলে?”
”সেই জন্যেই তো রাগ করছি। আমার একেবারে খেতে ইচ্ছে করে না। কেউ চুরি করে খেলে কত ভালো হত-”
আমরা সবাই হি হি করে হাসলাম, সুজন বলল, “ঠিক আছে ঠিক আছে এখন থেকে চুরি করে খাব। কোনো চিন্তা নাই।”
বজলু বলল, “তোমার আম্মুকে বল ভালো ভালো নাস্তা বানিয়ে দিতে!”
ম্যাডাম বললেন, “এমনিতে সবকিছু ঠিক আছে আঁখি?”
“আছে ম্যাডাম।”
“নতুন স্কুলে ভালো লাগছে?”
“লেখাপড়া ছাড়া আর সবকিছু ভালো লাগছে।”
আমরা হি হি করে হাসলাম। ম্যাডাম বললেন, “ভেরি গুড! আমি সেটাই চাই। লেখাপড়া ছাড়া আর সবকিছু ভালো লাগুক। পৃথিবীতে এমন কোনো ছাত্রছাত্রী নেই যার লেখাপড়া ভালো লাগে। যদি দেখা যায় কারো লেখাপড়া ভালো লাগছে তা হলে বুঝতে হবে তার মাথায় গোলমাল আছে।”
আমাদের মাঝে রাজু লেখাপড়ায় সবচেয়ে ভালো, প্রতিবার পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়। আমরা তার দিকে আঙুল দেখিয়ে আনন্দে চিৎকার করতে লাগলাম, “মাথায় গোলমাল! মাথায় গোলমাল!” বেচারা রাজু লজ্জা পেয়ে লাল নীল বেগুনি হতে লাগল। মুখ গোঁজ করে বলল, “আমি কি কখনো বলেছি লেখাপড়া করতে ভালো লাগে? করতে হয় তাই করি।”
আমরা রাজুকে আরো জ্বালাতন করতাম কিন্তু ম্যাডাম আমাদের থামালেন, বললেন, “আমাদের লেখাপড়ার স্টাইলটা খুব খারাপ সেই জন্যে তোমাদের এতো খারাপ লাগে। যখন আমরা স্টাইলটা ঠিক করব তখন দেখো এতো খারাপ লাগবে না!”
আমি ঠিক বুঝলাম না, লেখাপড়ার আবার স্টাইল কী। আর যদি থেকেও থাকে তা হলে সেটা আবার ঠিক করবে কেমন করে? আমি তাই হাত তুলে জিজ্ঞেস করলাম, “ম্যাডাম! লেখাপড়ার স্টাইল ঠিক করে কেমন করে?”
“যেমন মনে কর এই ক্লাস রুমটাবেঞ্চগুলো সারি সারি সাজানো-যারা সামনে বসেছে তারা আমাকে কাছে থেকে দেখছে কাছে থেকে কথা শুনছে। যারা পিছনে তারা দূর থেকে দেখছে দূর থেকে শুনছে। হয়তো সবসময় ভালো করে শুনছেও না। ক্লাসে স্যার-ম্যাডামরা কথা বলে যায়–তোমাদের নিশ্বাস বন্ধ করে শুনতে হয়। কিন্তু ক্লাস রুমটা মোটেও এরকম হবার কথা না–”
“কীরকম হবার কথা ম্যাডাম?”
ম্যাডামের চোখে-মুখে কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন ভাব ফুটে উঠল। হাত দিয়ে দরজাটা দেখিয়ে বললেন, “ঢুকতেই এখানে একটা অ্যাকুরিয়ামে থাকবে কিছু মাছ, ছোট ছোট কচ্ছপ। ওখানে একটা খরগোশের ফ্যামিলি। এখানে একটা কম্পিউটার।” দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এখানে সারি সারি তাক, সেই তাক ভরা রাজ্যের বই। রঙের বাক্স। কাগজ কলম রং পেন্সিল। যন্ত্রপাতি ক্রু ড্রাইভার সায়েন্স কিট। ক্লাসের দেয়ালে চারিদিকে ব্ল্যাকবোর্ড। তোমরা বসবে ছোট ছোট গ্রুপে-একটা টেবিলের চারপাশে।” ম্যাডাম হাত দিয়ে দেখালেন, “এখানে কয়েকজন, ওখানে কয়েকজন। মেঝেতে কোথাও হয়তো কার্পেট, কেউ কেউ হয়তো সেখানেই বসবে। আর আমরা যারা পড়াব তারা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে না পড়িয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াব, কখনো এখানে কখনো ওখানে। আমি হয়তো কিছুক্ষণ পড়ালাম তারপর তোমরা কথা বললে। নিজেরা নিজেরা আলোচনা করলে। পড়তে পড়তে হয়তো উঠে গেলে ওখানে টবে হয়তো গাছ লাগিয়েছ সেগুলোতে পানি দিলে। জানালার ওখানে হয়তো পাখি কিচিরমিচির করছে তাদের কিছু খেতে দিলে!” ম্যাডাম একটা নিশ্বাস ফেলে থামলেন, তার মুখটাতে কেমন যেন দুঃখ দুঃখ ভাব চলে এল। আমাদের এরকম একটা ক্লাস রুম দিতে পারছেন না–মনে হল সেই জন্যে তার মন খারাপ হয়ে গেছে।