আমরা যেরকম আঁখিকে নিয়ে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি আঁখিও মনে হয় এই নতুন স্কুলে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সে স্কুলে আসে বেশ আগে, সাধারণত তার আব্বু নামিয়ে দিয়ে যান। ক্লাসে এসে টেবিলে বই রেখে প্রায় সময়ই সে বের হয়ে স্কুলের পিছন দিকে চলে যায়। সেখানে বড় বড় কয়েকটা গাছ আছে, সেই গাছগুলোতে পাখির কিচিরমিচির শোনা তার খুব প্রিয় একটা কাজ। ছোট ক্লাসের বাচ্চাগুলো সেখানে দৌড়াদৌড়ি করে। তাদের গলার স্বর শুনে শুনে সে প্রায় সবগুলো বাচ্চাকে আলাদা করতে পারে-কারো নাম জানে না, কখনো দেখেনি শুধু গলার স্বর দিয়ে আলাদা আলাদা করে চেনা কাজটা মোটেও সোজা না–কিন্তু আঁখির কাছে সেটা কোনো ব্যাপারই না।
দুপুরবেলা আমরা মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে খেলতাম-আমাদের প্রিয় খেলা ছিল ক্রিকেট না হয় সাতচাড়া। স্কুলের লাইব্রেরিটা চালু হবার পর আমরা খুব উৎসাহ নিয়ে লাইব্রেরিতে বই পড়তে যেতাম-যখন আবিষ্কার করেছি লাইব্রেরিটা প্রত্যেক দিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত খোলা, আমরা যখন খুশি লাইব্রেরিতে যেতে পারি, যে কোনো বই নিতে পারি–সবচেয়ে বড় কথা হঠাৎ করে আবার লাইব্রেরিটা বন্ধ হয়ে যাবে না–তখন আমরা আবার মাঠে ছোটাছুটি করে খেলতে শুরু করলাম। আমাদের এই দুইটা প্রিয় কাজ আঁখি করতে পারত না। লাইব্রেরিতে গিয়ে বইয়ে হাত বুলানো ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই। মাঠে ক্রিকেট কিংবা সাতচাড়া খেলার কোনো প্রশ্ন আসে না। আমরা যখন মাঠে ছোটাছুটি করে খেলি আঁখি তখন বারান্দায় পা দুলিয়ে বসে আমাদের খেলা উপভোগ করে। চোখে না দেখেও যে এতো মজা করে কেউ খেলা উপভোেগ করতে পারে আঁখিকে না দেখলে আমরা সেটা বিশ্বাস করতাম না। আমাদের খুব ইচ্ছে করত আঁখিকে নিয়ে কোনো একটা কিছু খেলতে কিন্তু সে রকম কিছুই ভেবে বের করতে পারিনি। একমাত্র খেলা হতে পারে কানামাছি ভোঁ ভোঁ-সেই খেলায় কেউ নিশ্চয়ই আঁখিকে হারাতে পারবে না–কিন্তু আমরা সবাই তো বড় হয়ে গেছি এখন আমরা কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলি কেমন করে?
.
এর মাঝে একদিন নতুন ম্যাডাম আমাদের ক্লাস নিতে এলেন। আমাদের ভূগোল স্যারের বাবা মারা গেছেন, স্যার তাই বাড়ি গেছেন। প্রথম দিন ক্লাসে কেউ এল না তাই আমরা মহা ফূর্তি করে কাটালাম। আমাদের ক্লাস ক্যাপ্টেন হচ্ছে আশরাফ, সে খুবই ভালো একজন ক্লাস ক্যাপ্টেন, আমরা যখন ক্লাসে হইচই করি তখন সে শুধু চোখ পাকিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে ভয় দেখায়, “খবরদার গোলমাল করবি না, গোলমাল করলেই কিন্তু নাম লিখে স্যারদের দিয়ে দিব। পিটিয়ে তোদের বারোটা বাজিয়ে দেবে!” কিন্তু সে কখনোই আমাদের নাম লেখে না। মাঝে মাঝে সে ভান করে কারো একজনের নাম লিখে ফেলছে–আসলে শুধু হিজিবিজি লিখে রাখে। আমরা সবাই এতদিনে বুঝে গেছি আশরাফের মনটা খুবই নরম, সে কোনোদিন আমাদের কারো বিরুদ্ধে নালিশ করতে পারবে না। তা ছাড়া আমরা জেনে গেছি আমাদের স্কুলে স্যার-ম্যাডামরা আর আমাদের মারতে পারবে না। নালিশ করলে তারা বড়জোর বকাবকি করতে পারে-বকাবকিকে কে আর ভয় পায়? তাই আমাদের ক্লাসে যদি কোনো স্যার-ম্যাডামের আসতে একটু দেরি হয় তা হলে ক্লাসের ভিতরে তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়ে যায়–বাইরে থেকে যে কেউ মনে করতে পারে ভিতরে বুঝি কাউকে মার্ডার করা হচ্ছে। প্রথম দিন যখন স্যার এলেন না তখন আমরা এতো গোলমাল করলাম যে আশেপাশের ক্লাস থেকে নিশ্চয়ই সবাই নালিশ করেছিল, তাই পরের দিন ক্লাস শুরু হতেই আমাদের নতুন ম্যাডাম এসে হাজির হলেন। তাকে দেখে আমরা সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম। নতুন ম্যাডাম আমাদের চিৎকার করতে দিলেন, তারপরে হাসি হাসি মুখ করে বললেন, “ব্যাপারটা কী? তোমাদের চিৎকারের জন্যে আমাদের স্কুলটাকে না আবার নিষিদ্ধ করে দেয়।”
সুজন দাঁত বের করে হেসে বলল, “দোষটা তো আপনারই ম্যাডাম।”
ম্যাডাম অবাক হয়ে বললেন, “দোষ আমার?”
“জি ম্যাডাম। আপনি সবগুলো বেত পুড়িয়ে স্কুলে পিটাপিটি তুলে দিয়েছেন। এখন কেউ আর কোনো কিছুকে ভয়ডর পায় না। সবাই খুবই আনন্দ করে, দুষ্টুমি করে, গোলমাল করে।”
ম্যাডাম বললেন, “তা হলে কি তুমি বলছ আমি বাজার থেকে বেত কিনে এনে আবার নতুন করে পিটাপিটি শুরু করে দেব?”
আমরা সবাই দুই হাত ছুঁড়ে মাথা নেড়ে চিৎকার করে বললাম, “না-না-না। কক্ষনো না।”
“তা হলে চুপ করে বস সবাই-কথা বলি তোমাদের সাথে।”
আমরা সবাই তখন সাথে সাথে চুপ করে বসলাম। ম্যাডাম পুরো ক্লাসের দিকে একনজর তাকিয়ে বললেন, “আমি কয়েকদিন থেকে ভাবছিলাম তোমাদের ক্লাসে একবার আসি–কিন্তু সবকিছু নিয়ে এত ব্যস্ত যে একেবারে সময় করতে পারি না।” ম্যাডাম কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন, “তোমাদের ক্লাসে কেন আমি আসতে চাচ্ছিলাম তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ?”
আমরা সবাই মাথা নাড়লাম, রিতু বলল, “জি ম্যাডাম। আপনি দেখতে চাচ্ছিলেন আমরা কি আঁখিকে জ্বালাচ্ছি না কি আদর যত্ন করছি!”
“ঠিক বলেছ।” ম্যাডাম মাথা নাড়লেন, “আমি খুব বড় একটা ঝুঁকি নিয়েছিলাম, তোমরা কেউ কিছু জান না তার মাঝে আমি আঁখিকে পাঠিয়ে দিলাম। যদি কিছু একটা গোলমাল হত-যদি আঁখি অ্যাডজাস্ট করতে না পারত, যদি মন খারাপ করত—”