- বইয়ের নামঃ আঁখি এবং আমরা ক’জন
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১-২. ছিটেফোঁটা আনন্দ নেই
আঁখি এবং আমরা ক’জন – কিশোর উপন্যাস – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
যখন আমি বুঝতে পেরেছি যে আমাদের জীবনের কোথাও ছিটেফোঁটা আনন্দ নেই
কিছুদিন থেকে আমার দিনকাল বেশি ভালো যাচ্ছে না। আসলে শুধু কিছুদিন না–আমি যদি একটু চিন্তা করি তা হলে মনে হতে থাকে যে অনেকদিন থেকেই আমার দিনকাল বেশি ভালো যাচ্ছে না। আমি যদি সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে অনেকক্ষণ ধরে খুব গভীরভাবে চিন্তা করি তা হলে মনে হয় আমি বের করে ফেলতে পারব যে আসলে কখনোই আমার দিনকাল বেশি ভালো যায় নাই। (তবে আমি কখনোই কোনো কিছু নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে পারি না-যে কোনো জিনিস নিয়ে একটুক্ষণ চিন্তা করলেই আমার কেমন জানি দম আটকে আসে।)
আমার যে দিনকাল ভালো যাচ্ছে না সেটা বোঝার জন্যে খুব বেশি চিন্তা করার দরকারও হয় না-চিন্তা না করেও সেটা বের করে ফেলা যায়। আমরা দুই ভাই, আমার বড় ভাইয়ের নাম টিটু আমার নাম তিতু। বড় ভাইকে সবাই ঠিক করে ডাকে টিটু, বেশিরভাগ মানুষ আমাকে তিতু না ডেকে ডাকে তিতা। যারা আবার একটু বেশি ঢং করতে চায় তারা মুখটা সুচালো করে নাকি সুরে বলে তেঁতো, তারপর এমনভাবে মুখের একটা ভঙ্গি করে যেন কেউ সত্যি সত্যি তাদের মুখে তেতো করলার রস ঢেলে দিয়েছে। আমি ঠিক করেছি বড় হওয়া মাত্রই হাইকোর্টে মামলা করে আমার নামটা বদলে ফেলব। কী নাম নেব এখনো ঠিক করি নাই–তবে সেই নাম নিয়ে কেউ যে ঢং করতে পারবে না সেটা আমি এখন থেকেই ঘোষণা দিয়ে রাখতে পারি।
আমাদের বাসায় আমরা টিটু তিতু এই দুই ভাই ছাড়াও আছে আমার আব্বু, আম্মু আর ফুলি খালা। আব্বু ব্যাংকে চাকরি করেন আম্মু একটা স্কুলে পড়ান আর বলা যেতে পারে ফুলি খালা আমাদের সবাইকে দেখেশুনে রাখেন। ফুলি খালার মেজাজ অবশ্যি খুবই গরম, দুই তিনদিন পরে পরেই চিৎকার করে বলেন, “আমি আর এই বাসায় থাকব না! এই বাসায় কোনো মানুষ থাকতে পারে না। এখানে কোনোরকম নিয়মনীতি নাই, কোনো রকম শৃঙ্খলা নাই, আমি একজন মানুষ কতো কাজ করব? বাসায় কাজ করি তার মানে কি আমি ক্রীতদাস? শপিংমল থেকে আমাকে কিনে এনেছে?”
ফুলি খালা ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়েছেন তাই কথাবার্তা বলেন শুদ্ধ ভাষায়। আমি ভুলভাল কথা বললে মাঝে মাঝে আমাকে শুদ্ধ করে দেন। আমাদের বাসায় আমরা সবাই ফুলি খালাকে ভয় পাই। সবচাইতে বেশি ভয় পান আম্মু আর তার থেকেও বেশি ভয় পান আব্বু। যখন ফুলি খালা কাছাকাছি থাকেন না তখন আম্মু চোখ পাকিয়ে বলেন, “এই ফুলিকে আমি বাসা থেকে বিদায় করব। কাজের বুয়া হয়ে আমাদের সাথে কী ভাষায় কথা বলে লক্ষ করেছ?”
আব্বু বলেন, “লক্ষ করি নাই আবার! সে কি ভলান্টারি কাজ করে? মোটেই। মাসের শেষে গুনে গুনে টাকা দেই। দুই ঈদে বোনাস।”
“গত ঈদে শাড়ি কিনে দিয়েছি।”
“কতো বড় সাহস–আমি রাত্রে টেলিভিশন দেখছি, আর আমাকে এসে বলে, অনেক রাত হয়েছে। টেলিভিশন বন্ধ করে ঘুমাতে যান। বলে খট করে টেলিভিশনটা বন্ধ করে দিল!”
আম্মু নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলেন। আবার যখন ফুলি খালা আশেপাশে থাকেন তখন দুইজনই একেবারে কেঁচোর মতো হয়ে যান। আম্মু আহাদি গলায় বলেন, “ফুলি, তোমার চিকেনটা আজকে যা ভালো হয়েছে কী বলব।”
আব্বু বলেন, “ইউ আর এ জিনিয়াস ফুলি। তোমার আসলে ফাইভ স্টার হোটেলের কুক হওয়া উচিত ছিল।”
আম্মু বলেন, “গ্রামের বাড়িতে তোমার সবাই ভালো আছে তো?”
আবু বলেন, “সামনের মাসে তোমাকে একটা মোবাইল টেলিফোন কিনে দেই। তা হলে যখন ইচ্ছা হবে বাড়িতে কথা বলতে পারবে।”
তখন ফুলি খালা মুখ ঝামটা দিয়ে বলেন, “এর চাইতে লোহার শিক গরম করে আমার কপালে দুইটা ছ্যাকা দেন। মোবাইল ফোন আর টেলিভিশন এই দুই জিনিস আমি দুই চোখে দেখতে পারি না। কে এই দুইটা জিনিস আবিষ্কার করেছিল কে জানে–তার ওপরে নিশ্চয়ই আল্লাহর গজব পড়বে।”
আবু আর আম্মু দুইজনেই ফুলি খালার কথার সাথে সাথে মাথা ঝাঁকাতে থাকেন। আম্মু বলেন, “ঠিকই বলেছ ফুলি। মোবাইল টেলিফোনে বেশি কথা বললে না কি ব্রেনের মাঝে ক্যান্সার হয়।”
আব্বু বলেন, “ইউ আর রাইট ফুলি। ইউ আর হান্ড্রেড পার্সেন্ট রাইট। পৃথিবী থেকে টেলিভিশন ব্যান করে দেওয়া দরকার! সময়ের কী ভয়াবহ অপচয়।”
এই হচ্ছে আমার আব্বু, আম্মু আর ফুলি খালা। তবে এই তিনজনকে নিয়ে আমার বেশি সমস্যা নাই–আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমার বড় ভাই টিটুকে নিয়ে। সে কিছুদিন আগেও ঠিকঠাক ছিল আস্তে আস্তে কেমন যেন আজব হয়ে গেল। এখন দিনরাত খালি সে পড়ে, পড়তে পড়তে তার চেহারার মাঝে ভালো ছাত্র ভালো ছাত্র ভাব চলে এসেছে। ঘাড়টা একটু কুঁজো, গলাটা চিকন, চোখ দুইটা গর্তের ভিতর এবং ঠোঁটের ওপর খুব হালকা গোঁফ ওঠার চিহ্ন। যতক্ষণ স্কুলে থাকে ভাইয়া কী করে আমি জানি না কিন্তু যতক্ষণ বাসায় থাকে ততক্ষণ সে গুনগুন গুনগুন করে নাকি সুরে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে কিছু একটা মুখস্থ করে। আমি আর তার ধারেকাছে যাই না, গেলেই তার বইটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, “এই তিতা, দেখ দেখি আমার এই পৃষ্ঠাটা ঠিকমতোন মুখস্থ হয়েছে কি না।”