পড়ার টেবিলে কয়েকটা যোগ অঙ্ক করে তপু বলল, “টু-টু-টুশি আপু, খি খিদে পেয়েছে।”
টুশি মাথা চুলকাল, তার নিজেরও খিদে পেয়েছে। চাচা-চাচি যাবার সময় কিছু বলে যান নি, তাই তারা ধরেই নিয়েছে যে বেশি রাত হবার আগে চলে আসবেন। কিন্তু মোটামুটি রাত হয়ে আসছে তারা এখনও আসছেন না–রাতের খাবারের কী হবে টুশি বুঝতে পারছে না। টুশি জিজ্ঞেস করল, “বেশি খিদে পেয়েছে?”
তপু মাথা নাড়ল। টুশি বলল, “আয় দেখি ফ্রিজে কী আছে।” ফ্রিজ খুলে দেখা গেল সেখানে কিছু নেই একটা বাটিতে শুকনো কয়েকটা চিমসে হয়ে থাকা পটলভাজি–সেটা দিয়ে তো আর রাতের খাবার হতে পারে না। ফ্রিজে কোনো খাবার নাই দেখে তপুর খিদে মনে হয় এক লাফে আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল।
টুশি বলল, “তুই কোনো চিন্তা করিস না। চাচা-চাচি আসতে দেরি করলে আমি রান্না করে ফেলব।”
তপু চোখ বড় বড় করে বলল, “তু-তু-তুমি রান্না করতে পার?”
“পারি না আবার!” টুশি তপুকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে একটু বাড়িয়ে চাড়িয়ে বলল, “আমি সবকিছু রাঁধতে পারি। ভাত ডাল ডিমভাজি খিচুড়ি।” কথাটা বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যে বলল, “জমিলার মা আমাকে সবকিছু শিখিয়ে দিয়েছে।”
“স-স-সত্যি?”
“সত্যি নয়তো মিথ্যা? দেখাব রান্না করে?”
আব্ব আম্মু না এলেও তপুকে না খেয়ে থাকতে হবে না জেনে তপু খানিকটা ভরসা পেল, সে জ্বলজ্বলে চোখে টুশির দিকে তাকিয়ে বলল, “তু-তু-তুমি কী রান্না করবে?”
“সেটা নির্ভর করে বাসায় কী আছে তার উপর। যেমন মনে কর বাসায় আছে শুধু চাল ডাল আর ডিম। তা হলে মনে কর”
টুশি কথা শেষ করার আগেই টেলিফোন বাজল, টুশি চোখ বড় বড় করে বলল, “এটা নিশ্চয়ই চাচা নাহয় চাচি।” সে দৌড়ে গিয়ে টেলিফোন ধরল, “হ্যালো।”
“হ্যালো। কে টুশি?”
তপুর আম্মুর গলার স্বর, টুশি বলল, “জি চাচি, আমি।”
“আমরা একটা ঝামেলায় আটকে গেছি। এমনও হতে পারে যে আজ রাতে আমরা নাও আসতে পারি।”
“নাও আসতে পারেন?”
“হ্যাঁ। তোমরা খেয়ে ঘুমিয়ে যেয়ো। দরজা বন্ধ করে রেখো।”
“ঠিক আছে চাচি।”
“ভয় পাবে না তো?”
টুশির হঠাৎ করে ভয় ভয় লাগতে থাকে কিন্তু সেটা তো আর বলা যায় না, তাই চি-চি করে বলল, “না চাচি ভয় পাব না।”
“কিছুতেই দরজা খুলবে না।”
“ঠিক আছে চাচি, দরজা খুলব না।”
“আজ যদি খুব বেশি রাত হয়ে যায় তা হলে কাল সকালে আসব। কাল তো তোমাদের স্কুল নাই?”
“না চাচি।”
“গুড।”
তারা আজ রাতে কী খাবে সেটা জিজ্ঞেস করতে চাইছিল কিন্তু তার আগেই অন্য পাশ থেকে চাচি টেলিফোনটা রেখে দিলেন। টুশি টেলিফোন রেখে তপুর দিকে তাকিয়ে বলল, “চাচা-চাচি আজ রাত্রে নাও আসতে পারেন।”
“না-না-না-নাও আসতে পা-পা-পারেন?” হঠাৎ করে তপুর তোতলামি বেড়ে গেল। টুশি সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “তুই ভয় পাচ্ছিস কেন? ভয় পাবার কী আছে?”
“রাত্রে যদি ভূ-ভূ-ভূত আসে?”
ভূতের কথা শুনে টুশির পেট ভয়ে মোচড় দিয়ে উঠল, কিন্তু সে মুখে সেটা বুঝতে দিল না। সাহসের ভাব দেখিয়ে বলল, “ধুর! ভূত আবার কিছু আছে নাকি। আয়াতুল কুরসি বললে ভূত ধারেকাছে আসে না।”
“তু-তু-তুমি আয়াতুল কুরসি জান?”
“একেবারে মুখস্থ, কণ্ঠস্থ ঠোঁটস্থ। পড়ে তোকেও একটা ফুঁ দিয়ে দেব।”
টুশির কথা শুনে তপু একটু সাহস পেল। টুশি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, “তা ছাড়া ঢাকা শহরে যত গাড়ি, লাইট শব্দ আর ধোঁয়া–এখানে ভূত কেন ভূতের বাবাও আসবে না!”
তপু ভয়ে ভয়ে বলল, “কে-কেন টুশি আপু?”
“জিন ভূতেরা লাইট ধোয়া শব্দ এইসব খুব ভয় পায়।”
“ও।”
টুশি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “আয় আমরা রান্না করে ফেলি।”
তপুর চোখেমুখে খানিকটা উৎসাহ ফুটে উঠল, বলল, কী-কী মজা হবে, তা তা-তাই না টুশি আপু?”
টুশি এ ব্যাপারে খুব নিশ্চিত ছিল না কিন্তু সেটা তপুকে বুঝতে দিল না। বলল, “হ্যাঁ অনেক মজা হবে!”
খাবারের মেনুকে খুব সহজ করার চেষ্টা করা হল, খিছুড়ি এবং ডিমভাজা। চাল এবং ডাল মেপে ডেকচিতে ঢালা হল। কীভাবে রান্না করতে হয় সেটা নিয়ে টুশির ভাসাভাসা একটা ধারণা ছিল, কিন্তু কতটুকু রান্না করতে হয় সেটা সম্পর্কে তার কোনো ধারণা ছিল না। রান্না করার আগে যে জিনিসটা থাকে অল্প একটু, রান্না করার পর সেটা ফুলে ফেঁপে এত বিশাল আকার নিয়ে নেয় যে সেটা টুশি কল্পনাও করে নি। তাই প্রায় ঘণ্টাখানেক পর যখন রান্না শেষ হয়েছে তখন টুশি এবং তপু। আবিষ্কার করল যেটুকু রান্না হয়েছে সেটা তারা চোখ বুজে সপ্তাহখানেক খেতে পারবে। তপু ভয়ে ভয়ে বলল, “এ-এ-এতগুলো কে খাবে?”
টুশি একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “আমি তো আরও কম রাঁধতে চেয়েছিলাম, তুই না বললি বেশি করে রাধার জন্যে। তোর নাকি অনেক খিদে পেয়েছে। এখন বেশি করে খা।”
কাজেই দুজনেই বেশি করে খেল। খিদে বেশি পেয়েছিল বলেই কি না জানা নেই দুজনের কাছেই নিজেদের রান্নাকে মনে হল প্রায় অমৃত। খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে দুজনে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল–রান্না করা ব্যাপারটি সহজ হতে পারে কিন্তু রান্নার প্রস্তুতির অংশটা সহজ না। সারা রান্নাঘরে চাল, ডাল, বাটি, চামুচ, পেঁয়াজ, পেঁয়াজের খোসা, ডিম, ডিমের ছিলকে, কাঁচামরিচ, শুকনো মরিচ তেল লবণ বাসন পাতিল ছড়ানো–হঠাৎ দেখলে মনে হয় এখানে একটা টর্নেডো হয়ে গেছে। টুশি রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে বলল, “চাচি আসার আগে এটা পরিষ্কার করতে হবে। না হলে চাচি খুব রাগ করবে।”