টুশি কী বলবে বুঝতে পারল না, সে তপুর দিকে তাকাতে পারছিল না; দুর্বলভাবে বলল, “বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে।”
“আর কত বড় হবে? সে কি চার বছরের খোকা? তার বয়স সাত। স্পিচ থেরাপিস্টরা কতরকম এক্সারসাইজ দিয়েছে, সকাল-বিকাল প্র্যাকটিস করার কথা, এই পাজি ছেলে কিছু করে? প্রবলেমটা কার? তার না আমার?”
টুশি বলল, “আপনি কিছু চিন্তা করবেন না চাচি। এখন তো আমি আছি, আমি তপুর সব এক্সারসাইজগুলি করিয়ে দেব।”
এই প্রথমবার চাচি একটু নরম হলেন, বললেন, “থ্যাংক ইউ। একটা অসুস্থ পঙ্গু ছেলে থাকা যে কী কষ্ট সেটা মা ছাড়া আর কেউ বুঝবে না।” চাচি ফোঁৎ করে একটা নিশ্বাস নিয়ে গলায় কান্না-কান্না ভাব নিয়ে এলেন এবং এই পুরো নাটকের মাঝে চাচা বিস্বাদ কড়কড়ে ভাতের সাথে আঠালো সবজি আর ফ্যাকাশে দানা দানা ডাল মিশিয়ে কোঁৎ কোঁৎ করে খেতে লাগলেন। মনে হয় তাঁর চারপাশে কী হয় তিনি তার কিছু দেখেন না শোনেন না বা বোঝেন না।
.
রাত্রিবেলা যখন টুশি আর তপু তাদের ঘরে একা তখন টুশি তপুকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “তোর আম্মু যে এক্সারসাইজের কথা বলেছে সেগুলো কী?”
তপু মুখ কালো করে বলল, “মা-মা-মারবেলের মতো বল মু-মু-মুখে রেখে ক-ক-কথা বলতে হয়।”
টুশি মুখ কুঁচকে বলল, “ছি! খবরদার ওগুলো করবি না। যতসব পাগলামি!”
“আ-আ-আম্মু যে বকে।”
“আমি তোকে ঠিক করে দেব।”
তপু অবাক হয়ে বলল, “ঠি-ঠিক করে দেবে?”
“হ্যাঁ। আমাকে কী দিবি বল?”
“স-স-সবগুলো কমিক দিয়ে দেব।”
“ধুর তোর ঐ কমিক কে পড়ে!”
তপু চিন্তিত মুখে বলল, “তা-তা-তা-হলে আমার লে-লে-লেজার গান।”
“আমি মেয়েমানুষ তোর লেজার গান দিয়ে কী করব? ক্যাশ টাকা দিবি কি না বল!”
“টা-টা-টাকা?” তপু খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। “ক-ক-কত টাকা?”
“লাখখানেক।”
“লা-লা-লা “
টুশি এবারে হি হি করে হেসে ফেলল, বলল, “তোকে টাকা দিতে হবে না, আমি এমনিতেই ঠিক করে দেব। শুধু”
“শুধু কী?”
“শুধু সবসময় আমার পক্ষে থাকবি। তুই আর আমি সবসময় একদিকে। ঠিক আছে?”
তপু একগাল হেসে বলল, “ঠি-ঠিক আছে।”
“ছোট থাকা খুব সমস্যা। বড় মানুষেরা খুব জ্বালাতন করে। এইজন্যে যারা ছোট তাদের সবসময় একসাথে থাকতে হয়। এখন থেকে তুই থাকবি আমার পক্ষে–আমি থাকব তোর পক্ষে।”
তপুর মুখ খুশিতে জ্বলজ্বল করতে থাকে। সে কাছে এগিয়ে এসে বলল, “আ আ-আমাকে তুমি কে-কে-কেমন করে ঠিক করবে?”
“সেটা সিক্রেট। এখন বলা যাবে না।”
“ক-ক-কখন বলবে?”
“সময় হলেই বলব।”
এরকম সময় চাচি ঘরে মাথা ঢুকিয়ে বললেন–”এত রাতে এত কথা কিসের, ঘুমিয়ে পড় দুজনেই।”
“জি চাচি ঘুমাচ্ছি।” টুশি তাড়াতাড়ি উঠে ঘুমানোর জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
সুটকেস খুলে ঘুমের কাপড় বের করার সময় প্রথমে তার প্রিয় বইগুলো দেখতে পেল। সেগুলো যত্ন করে বের করে টেবিলে রাখাতেই তার সেই বিচিত্র বোতলটা চোখে পড়ল। টুশি সাবধানে বোতলটা বের করে টেবিলে রাখতেই তপু জিজ্ঞেস করল, “এ-এটা কী?”
টুশি মুখ গম্ভীর করে বলল, “কেউ জানে না এই বোতলের ভিতরে কী আছে।”
“খু-খুলে দ্যাখো না কেন?”
“কেমন করে খুলব? দেখিস না কীভাবে সিলগালা করে রেখেছে।”
“কে রেখেছে?”
“কেউ জানে না।” টুশি রহস্যময় গলায় বলল, “একটা বিশাল কালো সিন্দুকের মাঝে এটা লুকিয়ে রেখেছিল একশ বছর।”
“স-স-সত্যি?”
“আমি কি তোর সাথে মিথ্যা কথা বলব?”
তপু খুব কৌতূহল নিয়ে বোতলটা দেখল, টুশি বলল, “আমার কী মনে হয় জানিস?”
“কী?”
“এই বোতলটার মাঝে আনন্দ আর স্ফুর্তি ঠেসে বন্ধ করা আছে। এটা খুলতেই চারিদিকে আনন্দ হতে থাকবে।”
তপু চোখ বড় বড় করে বলল, “সত্যি?”
“আমার তা-ই মনে হয়। তা না হলে কেন মানুষ একটা বোতল একশ বছর এইভাবে ছিপি দিয়ে বন্ধ করে আটকে রাখবে?”
তপু বোতলটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল, “বো-বো-বোতলটা খুলে দেখি!”
টুশি মাথা নাড়ল। বলল, “খুলব। যেদিন তোর আর আমার দুজনেরই কিছু নিয়ে মন খারাপ থাকবে সেদিন বোতলটা খুলব, সাথে সাথে দেখবি আমাদের মন ভালো হয়ে যাবে।”
তপু মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেল। টুশি একটা নিশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা তপু, তোর কি মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়?”
“আ-আ-আম্মু যখন বকে তখন মন খারাপ হয়।”
টুশি গম্ভীর গলায় বলল, “বকলে তো মন খারাপ হবেই। মন খারাপ করার জন্যেই তো বকে। কেউ কি মন ভালো করার জন্যে বকে? এমনি মন খারাপ হয়?”
“নাহ, হয় না।”
টুশি কোনো কথা বলল না, শুধু ছোট একটা নিশ্বাস ফেলল।
.
রাত্রিবেলা দুজনেই যখন শুয়েছে তখন টুশি তার বিছানা থেকে বলল, “তপু, ঘুমিয়ে গেছিস?”
“না।”
“তোকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি? সত্যি করে বলবি।”
“আচ্ছা।”
“আমাকে যখন প্রথম দেখেছিস তখন আমার চেহারাটা দেখে তোর কী মনে হয়েছিল? সত্যি সত্যি বলবি।”
তপু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ম-ম-মনে হয়েছিল, তোমার চেহারাটা বেশি ভা-ভালো না। এখন কিন্তু ভা-ভালোই মনে হচ্ছে।”
“ও।”
তপু জিজ্ঞেস করল, “কে-কেন আপু?”
টুশি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “না, এমনি।”
০৩. একলা রাত
মাস তিনেক পরের কথা। টুশি আর তপু তাদের পড়ার টেবিলে বসে পড়ছে। তপুর আব্ব আর আম্মু বাসায় নেই, বিকেলবেলা তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে গেছেন। বের হওয়ার সময়ে দুজনেই নিচু গলায় ফিসফিস করে চিন্তিত মুখে কথা বলছিলেন– কী নিয়ে এরকম চিন্তা সেটা তাদের বলে যান নি। তাদেরকে বলে যাবেন টুশি আর তপু সেরকম আশাও অবশ্যি করে নি। তাদেরকে এই বাসায় মানুষ বলেই বিবেচনা করা হয় না–টুশি বাইরের মানুষ, তাকে মানুষ বলে বিবেচনা না করলে অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু তপুকেও যেন হিসেবের মাঝেই নেয়া হয় না। চাচা-চাচির কথাবার্তা কাজকর্ম দেখে মনে হয় তপু যেন একটা জীবাণু, পারলে ফিনাইল দিয়ে ধুয়ে তাকে যেন নর্দমায় ফেলে দেয়া হবে! বেচারা তপুর দোষটা কোথায় সেটা টুশি এখনও বুঝতে পারে নি, তার কথাবার্তায় একটু তোতলামো আছে কিন্তু সেটা তো আর কারও অপরাধ হতে পারে না। এমনিতে তপুর মতো মিষ্টি স্বভাবের ছেলে পাওয়া কঠিন, এই বাসায় যদি তপু না থাকত তা হলে টুশি বহু আগে পালিয়ে জমিলার মায়ের কাছে চলে যেত।