“তোমার বিশাল বপু–
সেই জন্যে তোমার নাম তপু।”
ছেলেটা ফিক করে একটু হেসে ফেলল, তারপর প্রথমবার মুখ খুলল, জিজ্ঞেস করল, “ব-ব-বপু মানে কী?”
ছেলেটা একটা কথাও না বলে কেন শুধু মাথা নেড়ে নেড়ে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল টুশি এবারে সেটা বুঝতে পারে। কথা বলার সময় তার নিশ্চয়ই একটু তোতলামো এসে যায় এবং সেটা নিয়ে লজ্জা পায়। টুশির খুব মায়া হল ছেলেটার জন্যে তাই ভান করল সে তোতলামোটুকু লক্ষই করেনি। বলল, “বপু মানে জানিস না? বপু মানে হচ্ছে শরীর।”
“আ-আ-আমার শরীর কি বিশাল?”
টুশি চোখ কপালে তুলে বলল, “ওমা! তোর শরীর যে বিশাল জানিস না? এই দ্যাখ তোর কত বড় ভুড়ি-তুই যখন হাঁটিস তখন তোর ভুঁড়ি থলথল করে। তোর হাত হচ্ছে থাম্বার মতো মোটা। তোর গালের পাশে চর্বি জমে আছে, তোর মুখ এত মোটা যে তোর চোখ দুটো দেখাই যায় না ছোট ছোট ইঁদুরের মতো কুকুতে চোখ”
তপু টুশির মুখে নিজের বর্ণনা শুনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল, তারপর বলল, “তু-তুমি একটা জোকার।”
“উঁহু।” টুশি মাথা নাড়ল, “ছেলেরা হয় জোকার। মেয়েরা হয় জোকারনি।”
তপু আবার হি হি করে হাসতে থাকে। তপুর হাসির শব্দ শুনে তার আম্মু ঘরে উঁকি দিলেন এবং সাথে সাথে তপু হাসি বন্ধ করে ফেলল, এই বাসায় হাসাহাসি করা মনে হয় নিষেধ। আম্মু ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে?”
তপু কথা বলার চেষ্টা করল কিন্তু হঠাৎ করে তার তোতলামোটা অনেক বেড়ে গেল, সে কথা শুরুই করতে পারল না, আম্মু মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “হোম-ওয়ার্ক করেছিস?”
তপু মাথা নেড়ে জানাল হোমওয়ার্ক করেনি। আম্মু কঠিন মুখে বললেন, “হোম-ওয়ার্ক না করে ইডিয়টের মতো হাসছিস যে বড়? হোম-ওয়ার্ক শেষ কর।”
তপু সাথে সাথে যন্ত্রের মতো উঠে গিয়ে টেবিল থেকে খাতা বই টানাটানি করতে থাকে। পুরো ব্যাপারটার মাঝে টুশি বাইরের একজন মানুষ হিসেবে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
.
তপুর ব্যাপারটা নিয়ে টুশির যে সন্দেহটা ছিল রাত্রে খাবার টেবিলে তার আব্ব আম্মু বাকিটা খোলাসা করে দিলেন। এই বাসায় কোনো কাজের মানুষ নেই, সব কাজ নিজেদের করতে হয় তাই রান্নার পরিশ্রম বাঁচানোর জন্যে সপ্তাহে একদিন রান্না। করে সেগুলো ফ্রিজ করে রাখা হয়–তারপর সারা সপ্তাহ সেগুলো বের করে গরম করে খাওয়া হয়। তপুর আম্মু রান্নাবান্না জানেন না–খাবার বিস্বাদ, তার উপর বাসি খাবার গরম করে খেতে গিয়ে টুশির নাড়ি উলটে আসে। খেতে খেতে টুশির মনে হয় একবেলা জমিলার মায়ের রান্না খাওয়ার জন্যে সে অর্ধেক পৃথিবী দান করে দেবে। টুশি কোনোমতে বিস্বাদ খাবার খাচ্ছে এবং তখন তপুর আম্মু সবজি নামের অত্যন্ত বিদঘুঁটে একটা জিনিস তপুর প্লেটে ধ্যাবড়া করে ছড়িয়ে দিয়ে ধমক দিয়ে বললেন, “ভেজিটবল খা বেশি করে। তোর নিশ্চয়ই ভাইটামিন ডেফিসিয়েন্সি হচ্ছে।”
বেচারা তপু মুখ কালো করে সেই বিস্বাদ জিনিস গেলার চেষ্টা করতে থাকে। তপুর আম্মু টুশির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, “তুমি এতক্ষণে নিশ্চয়ই তপুর প্রবলেমটা টের পেয়েছ?”
টুশি বুঝতে না পেরে বলল, “কী প্রবলেম?”
“স্পিচ ডিজওর্ডার।”
“স্পিচ কী?”
“ডিজওর্ডার।”
টুশি ভয়ে ভয়ে বলল, “কী হয় এটা হলে?”
তপুর আব্ব হাত নেড়ে বললেন, “তপুর তোতলামোর কথা বলছে।”
“ও!” টুশি নিশ্বাস ছেড়ে বলল, “তা-ই বলেন! আমি ভাবলাম, কী না কী!”
তপুর আম্মা কঠিন মুখে বললেন, “এটা খুব সিরিয়াস ব্যাপার। একজন মানুষ কীভাবে কথা বলে সেটা হচ্ছে সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট। সে যদি কথাই না বলতে পারে”
তপুর সামনে এভাবে কথা বলাটা টুশির একেবারেই পছন্দ হল না, বাধা দিয়ে বলল, “কে বলছে পারে না! তপু কী সুন্দর কথা বলে”
চাচি মাথা নাড়লেন, “বেশির ভাগ সময়েই পারে না। আমার কথা বিশ্বাস না করলে এখনই পরীক্ষা করো।” চাচি কঠিন মুখে তপুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তপু বল দেখি পৃথিবীর এক ভাগ স্থল তিন ভাগ জল–”।
তপু একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। খুব করুণ চোখে তার মায়ের দিকে তাকাল, কিন্তু চাচির মন এতটুকু নরম হল না, হুংকার দিয়ে বললেন, “বল। পৃথিবীর এক ভাগ স্থল তিন ভাগ জল।”
চাচা প্লেটে বিস্বাদ ভাতের সাথে বিস্বাদ ডাল মাখাতে মাখাতে বললেন, “থাক ছেড়ে দাও এখন।”
“কেন ছেড়ে দেব? তোমার লাই পেয়ে পেয়েই তপুর এই দশা। ডাক্তার বলেছে প্র্যাকটিস করতে–এই পাজি ছেলে প্র্যাকটিস করে?”
চাচা কোনো কথা না বলে খেতে লাগলেন। এই বাসায় শুধুমাত্র চাচাই মনে হয় চাচির রান্না করা এই বিস্বাদ খাবারগুলো শখ করে খান! চাচি আবার চোখ গরম করে তপুর দিকে তাকালেন, হুংকার দিয়ে বললেন, “বল, পাজি ছেলে।”
তপুর চোখে পানি এসে গেল, তার মাঝে সে কথা বলার চেষ্টা করল, “পি পি-পি-পৃ–”
“স্পষ্ট করে বল হতভাগা ছেলে।”
তপু ভাঙা গলায় বলল, “থু-থ-থি”
তপুর কষ্ট দেখে টুশির চোখেই পানি এসে যাচ্ছিল কিন্তু চাচির মন একটুও নরম হল না। তপু অনেক কষ্ট করে পৃথিবীর এক ভাগ পর্যন্ত বলে স্থল’ শব্দটিতে আটকে গেল, কিছুতেই সেটা বলতে পারল না। চাচি হিংস্র চোখে তপুর দিকে তাকিয়ে রইলেন এবং এক সময়ে মুখ ঘুরিয়ে টুশির দিকে তাকিয়ে যুদ্ধ জয় করার ভঙ্গি করে বললেন, “দেখেছ?”