টুশি আর তপু তখন আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল–”কা-বি-লি- কো-হ-কা ফী “।
কাবিল কোহকাফী চমকে উঠল। সে হতবুদ্ধি হয়ে এতক্ষণ উপরে তাকিয়ে ছিল, বিস্ফারিত চোখে দেখছিল কী ভয়ংকর অসহায় আর নিরুপায়ভাবে ত্রিশ ফুট উঁচুতে টুশি আর তপু ঝুলছে। সে দেখছিল মুখে কী ভয়ানক একটি জিঘাংসা নিয়ে দুইদিক থেকে কালাচান আর দবির মিয়া র্যাকটিকে আঁকিয়ে তাদেরকে ফেলে দিতে চেষ্টা করছে। হঠাৎ করে তপু আর টুশির চিৎকার শুনে কাবিল কোহকাফী থরথর করে কেঁপে উঠল। মনে হল তার শরীরের ভেতর যেন কী-একটা ঘটে গেছে। তার মাথার মাঝে যেন ভয়ংকর একটা বিস্ফোরণ ঘটে যায়, সমস্ত শরীরের মাঝে যেন বিদ্যুৎ খেলতে শুরু করে। প্রচণ্ড ক্রোধে তার শরীরের প্রত্যেকটা কোষ যেন ফেটে গেল, হঠাৎ সে দুই হাত উপরে তুলে ভয়ংকর জান্তব একটা ক্রোধে অমানুষিক গলায় চিৎকার দিয়ে ওঠে। হলভরতি দর্শকেরা হতবাক হয়ে দেখতে পেল খাঁচার ভেতরে আটকে-থাকা অদৃশ্য মানবটির সমস্ত শরীর হঠাৎ করে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে, দেখতে দেখতে তার সমস্ত শরীর ফুলে ফেঁপে উঠছে, তাকে ঘিরে ধোঁয়ার কুণ্ডলি উঠতে শুরু করেছে। সারা শরীর ঘিরে আগুনের ফুলকি ছুটছে। হাতের ঝটকা দিয়ে সেই মূর্তিটি তার শিকল ভেঙে ফেলল, তারপর লাথি দিয়ে খাঁচাটিকে ভেঙে ফেলে। হলঘরের সবাই দেখল তার সমস্ত দেহ ধোঁয়ার কুণ্ডলির মতো বড় হয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে, গগনবিদারী চিৎকারে সমস্ত হলঘর থরথর করে কেঁপে উঠছে।
টুশি আর তপু নিজেদেরকে আর ধরে রাখতে পারল না। হাত ফসকে তারা নিচে পড়ে গেল কিন্তু কাবিল কোহকাফীর বিশাল এক মূর্তি দুই হাতে তাদের ধরে ফেলল। তাদেরকে নিয়ে ঘুরপাক খেতে খেতে সেই বিশাল মূর্তি মঞ্চটিকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়–স্টেজের মানুষ ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে ছুটে পালাতে থাকে। টুশি আর তপুকে স্টেজে দাঁড় করিয়ে দিয়ে কাবিল কোহকাফীর এই ভয়ংকর প্রতিমূর্তি বিকট চিৎকার করতে করতে জ্বলন্ত আগুনের মতো ঘুরতে থাকে তার বিশাল দেহ। থেকে গলগল করে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে, ভয়ংকর ক্রোধে তার চোখ আগুনের মতো জ্বলছে, মুখ থেকে আগুনের হলকা বের হচ্ছে।
উপস্থিত দর্শকেরা এবারে প্রচণ্ড আতঙ্কে চিৎকার করে ছুটে পালাতে শুরু করল, মানুষের চিৎকার আর হুটোপুটিতে হলঘরের মাঝে একটা নারকীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যায়। টুশি বুঝতে পারল কাবিল কোহকাফীকে না থামালে এখানে একটা ভয়ংকর অবস্থা হয়ে যাবে। মানুষের পায়ের চাপেই কয়েকশ মানুষ মারা যাবে।
টুশি তখন চিৎকার করে বলতে লাগল, “থামো। কাবিল কোহকাফী তুমি থামো। প্লিজ!”
তপুও চিৎকার করে বলল, “থা-থা-থামো তুমি। থামো।”
টুশি তপুকে বলল, “বোতলটা দে, তাড়াতাড়ি।”
তপু পকেট থেকে বোতলটা বের করে দেয়, টুশি ছিপিটা খুলে উঁচু করে ধরে বলল, “কাবিল, আসো এখানে। এই বোতলের ভেতরে। এক্ষুনি। না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
ছুটোছুটি করতে-থাকা দর্শকেরা অবাক হয়ে দেখল ভয়ংকর সেই প্রতিমূর্তি হঠাৎ ধোঁয়ার কুণ্ডলী হয়ে ছোট মেয়েটির হাতে ধরে রাখা বোতলের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে সেই ভয়ংকর মূর্তি পুরোটুকু বাধ্য প্রাণীর মতো একটা ছোট মেয়ের হাতে ধরে থাকা বোতলের ভেতরে ঢুকে গেল।
টুশি বোতলটি মুখের কাছে এনে বলল, “থ্যাংক ইউ কাবিল কোহকাফী। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।”
তারপর বোতলের ছিপিটা লাগিয়ে সামনে তাকাল। কয়েক হাজার নারী-পুরুষ দর্শক হতবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, কারও মুখে একটা কথা নেই, নিজের চোখে দেখেও কেউ এটা বিশ্বাস করতে পারছে না। টুশি শক্ত করে বোতলটা ধরে তপুকে বলল, “আয় তপু। আমরা যাই।”
“চ-চলো আপু।”
তারা স্টেজ থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে থাকে, সব মানুষ সরে গিয়ে তাদের জায়গা করে দেয়। টুশি তপুর হাত ধরে হাঁটতে থাকে। টেলিভিশন ক্যামেরাগুলো তাদের দুজনের দিকে মুখ করে ধরে রেখেছে কিন্তু টুশি আর তপু সেটা নিয়ে ভ্রূক্ষেপ করল না। অসংখ্য ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আলো আর ক্লিক ক্লিক শব্দের মাঝে তারা ছুটতে লাগল। হঠাৎ সাহস করে একজন সাংবাদিক এগিয়ে এসে। জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কারা? এখানে কেন এসেছ?”
টুশি আর তপু সাংবাদিকের কথার উত্তর না দিয়ে এবারে ছুটতে থাকে– তাদের পিছুপিছু অসংখ্য সাংবাদিক ছুটে আসছে, তারা চিৎকার করে প্রশ্ন করছে। কিন্তু কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তারা ছুটতে থাকে। দুই হাতে শক্ত করে ধরে রাখে বোতলটাকে যার ভেতরে নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছে কাবিল কোহকাফী। তাকে এবারে মুক্ত করে দিতে হবে। চিরদিনের মতো।
১৬. শেষ কথা
নানির দুই হাত ধরে টুশি আর তপু টেনে নিয়ে যাচ্ছে–তার পিছনে পিছনে সুট টাই পরা বেশ কয়েজন মানুষ। নানি মাঢ়ি বের করে হাসার চেষ্টা করে বললেন, “আমাকে এভাবে টানছিস কেন?”
টুশি বলল, “তোমার দেয়া বাড়িতে কী সুন্দর ‘শিশুসদন’ হয়েছে দেখবে না?”
“দেখতেই তো এসেছি। যেভাবে টানছিস আমি দেখব কেমন করে?”
পিছনের সুট-টাই পরা মানুষগুলো একটু হাসল, বলল, “আপনার নাতি নাতনি হচ্ছে ডেঞ্জারাস মানুষ, তারা জিনকে ধরে শিশিতে ভরে ফেলে–আপনাকে যে সেরকম কিছু করছে না সেইটাই বেশি!”
নানি বললেন, “সত্যি কথাই তো! তোরা সেই জিনকে কী করেছিস? টেলিভিশনে এখনও দুই বেলা দেখায়”