টুশি আর তপু উপর থেকে নিচে তাকাল, স্টেজের উপর তখন কাবিল কোহকাফীকে দিয়ে একটা নৃশংস খেলা দেখানো হচ্ছে, সে স্টেজ ভেঙে বের হয়ে আসতে চাইছে এরকম একটা কথা বলে তাকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে খাঁচার মাঝখানে আটকে রাখার চেষ্টা করছে। তীব্র আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে বলে টুশি আর তপু ভালো করে কাবিল কোহকাফীকে দেখতে পাচ্ছে না–কিন্তু যেটুকু দেখছে সেটা দেখেই কাবিল কোহকাফীর কষ্টে তাদের বুক ভেঙে যেতে লাগল।
টুশি তপুকে বলল, “সামনে যা তপু।”
তপু কোনোরকমে কান্না আটকাতে আটকাতে বলল, “আমার ভ-ভয় করছে। আপু। য-যদি পড়ে যাই?”।
“পড়ে গেলে মরে যাবি তাই খবরদার পড়ে যাবি না। দুই হাতে শক্ত করে ধরে একটু একটু করে এগিয়ে যা। খবরদার নিচে তাকাবি না, নিচে তাকালেই কিন্তু মাথা ঘুরে পড়ে যাবি।”
“আমি পা-পারব না আপু।”
নিচে কালাচান রিভলবার তাক করে ধরে রেখেছে, সেদিকে একনজর তাকিয়ে টুশি বলল, “নিচে বদমাইশগুলো রিভলবার ধরে রেখেছে। পরে গুলি করে দেবে। সামনে আগাতে থাক। আমি তোকে ধরে রাখছি।”
তপু চোখ মুছে হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে শুরু করে। র্যাকটা প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচুতে স্টেজের দুইপাশ থেকে ঝোলানো, তারা এগুতে শুরু করা মাত্র সেটা বিপজ্জনকভাবে দুলতে শুরু করল। তপু সাথে সাথে বুক লাগিয়ে শুয়ে পড়ে চাপা স্বরে আর্তনাদ করে ওঠে। টুশির বুকও ভয়ে ধকধক করতে থাকে, মনে হয় এক্ষুনি বুঝি উপর থেকে নিচে পড়ে যাবে।
দুলুনি একটু কমে আসতেই টুশি আবার তপুর পিঠে হাত দিয়ে বলল, “ভয় পাবি না। আর একটু এগিয়ে যা।”
তপু তখন খুব সাবধানে প্রায় বুক আর পেটে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে এগুতে শুরু করল। টুশি পিছনে পিছনে যেতে থাকে, নিচে তাকাবে না তাকাবে না করেও হঠাৎ করে নিচে তাকিয়ে টুশির মাথা ঘুরে গেল, একটা আর্তচিৎকার করে সে থেমে যায়। তপু জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে টু-টুশি আপু?”
টুশি বড় একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “না, কিছু না।”
খুব সাবধানে র্যাকটির উপর বুক লাগিয়ে প্রায় গড়িয়ে গড়িয়ে দুজনে মাঝামাঝি এসে হাজির হল। নিচে আগুনের মতো গরম বাতাস, মনে হয় সারা শরীর বুঝি পুড়ে যাবে, তাদের মুখ শুকিয়ে যায়, সমস্ত শরীর ঝা ঝা করতে থাকে। তপু বলল, “আপু আর পারি না।”
টুশি বলল, “দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাক। দেখতে দেখতে এক ঘণ্টা কেটে যাবে।”
ঠিক তখন নিচে কাবিল কোহকাফীকে নিয়ে একটা ভয়ংকর খেলা হচ্ছে, মানুষ রুদ্ধশ্বাসে দেখছে কেমন করে একটা অদৃশ্য দানবকে আগুনের হলকা দিয়ে ভয় দেখানো যায়। পুরো ব্যাপারটি আরও ভয়ংকর করার জন্যে আলোর ঝলকানিতে চারদিক ঝলসে উঠছে, কান-ফাটানো ভয়ংকর একধরনের সংগীতে পুরো স্টেজ কেঁপে কেঁপে উঠছে।
হঠাৎ করে সবকিছু থেমে গেল, আলোর ঝলকানিও নেই, ভয়ংকর সংগীতও নেই, চারিদিকে একধরনের সুনসান নীরবতা। সুন্দর কাপড় পরা অনুষ্ঠানের উপস্থাপক কাঁপা গলায় বলল, “উপস্থিত সুধীমণ্ডলী, একটি অত্যন্ত জরুরি কারণে আমাদের কিছুক্ষণের জন্যে অনুষ্ঠানটি বন্ধ করতে হচ্ছে। আমাদের এই অনির্ধারিত বিরতির জন্যে আমরা দুঃখিত। আপনারা ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করুন, কিছুক্ষণের মাঝেই আমরা আবার অনুষ্ঠান শুরু করতে পারব।”
কী হয়েছে অনুমান করার জন্যে হলভরতি সব মানুষ নিচু গলায় কথা বলতে শুরু করে। স্টেজের উপর নিরাপত্তা পোশাক পরা কিছু মানুষ এসে টুশি আর তপুর দিকে মাথা উঁচিয়ে তাকিয়ে কথা বলতে থাকে। উপস্থাপক এগিয়ে আসে, তাদের সাথে কথা বলে সে উপরে তাকায়, ফ্লাডলাইটের র্যাক ধরে বিপজ্জনকভাবে ঝুলে থাকা টুশি আর তপুকে দেখে তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়। সে আবার দর্শকদের দিকে ঘুরে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল, “সুপ্রিয় দর্শকমণ্ডলী, আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, আমাদের স্টেজে একটি অত্যন্ত জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আপনারা কেউ নিজেদের আসন থেকে উঠবেন না। আমাদের নিরাপত্তাকর্মীরা এইমাত্র আমাদের জানিয়েছে একটি ছোট ছেলে এবং একটি ছোট মেয়ে এই স্টেজ থেকে ত্রিশ ফুট উঁচুতে ঝোলানো একটি র্যাকের উপরে উঠে পড়েছে। এই মেয়েটি কিছুক্ষণ আগে তার পোষা ইঁদুরকে হারিয়ে ফেলেছিল বলে জানিয়েছে, সম্ভবত সে তার পোষা ইঁদুরকে খুঁজতে এই বিপজ্জনক জায়গায় পৌঁছে গেছে।”
উপস্থিত সব দর্শক আতঙ্কের একধরনের শব্দ করল। উপস্থাপক, বলল, “আপনারা ভয় পাবেন না। শিশু দুজনকে উদ্ধার করার জন্যে আমাদের নিরাপত্তাকর্মীরা উপরে উঠে যাচ্ছে। দায়িত্বজ্ঞানহীন অবুঝ এই দুটি শিশুর এই বিপজ্জনক কাজের জন্যে আমাদের অনুষ্ঠানে এই বিঘ্ন ঘটেছে বলে আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।”
টুশি এবং তপু উপস্থাপকের কথা শুনে একেবারে হতবাক হয়ে গেল। কী বলছে এই মানুষগুলো–তারা তো এখানে নিজে থেকে ওঠেনি, তাদেরকে এখানে জোর করে তুলেছে। তপু কাঁপা গলায় বলল, “আমাদেরকে এখন কে উদ্ধার ক করবে আপু?”
ঠিক তখন টুশির মাথায় ভয়ংকর একটা চিন্তা এসেছে–সে জোর করে সেই চিন্তাটা দূর করে দিয়ে বলল, “হ্যাঁ। শুনলি না–তা-ই তো বলছে।”
“কি-কি-কিন্তু আপু আমরা তো নি-নিজে উঠিনি। এরা মি-মিথ্যা কথা বলছে কেন?”
এরা কেন মিথ্যা কথা বলছে কয়েক সেকেন্ড পরেই টুশি আর তপু বুঝতে পারল। তারা দেখল র্যাকের দুইপাশ থেকে কালাচান আর দবির মিয়া উঠে আসছে। তাদেরকে উদ্ধার করার জন্যে এগিয়ে আসার ভান করতে করতে কালাচান আর দবির মিয়া র্যাকটা দোলাতে শুরু করেছে, তাদের দুজনকে উপর থেকে নিচে ফেলে দেয়াই এদের উদ্দেশ্য। প্রচণ্ড আতঙ্কে তপু আর্তনাদ করে ওঠে, র্যাক থেকে সে প্রায় ছিটকে পড়ে যাচ্ছিল, কোনোমতে সরু র্যাকটা সে আঁকড়ে ধরল, তার সমস্ত শরীর পিছনে পড়ে গেছে, কোনোমতে শুধু দুই হাত দিয়ে র্যাকটা ধরে ঝুলে আছে। তপুকে বাঁচাতে টুশি হাত বাড়িয়ে ধরতে গেল, সে নিজেও তখন তাল সামলিয়ে পড়ে গেল। নিচে খাঁচার ধারালো শিক, ত্রিশ ফুট উপর থেকে পড়লে তারা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাবে। টুশি শেষ মুহূর্তে র্যাকটা ধরে ঝুলে পড়ল। উপস্থিত দর্শকেরা রুদ্ধশ্বাসে দেখতে পেল একটা সরু র্যাক থেকে ছোট একটা ছেলে আর মেয়ে কোনোমতে ঝুলে আছে। নিচে একটি খাঁচা–সেই খাঁচা থেকে ধারালো শিক উদ্যত হয়ে আছে, যে-কোনো মুহূর্তে এই বাচ্চা দুটি পড়ে সেখানে গেঁথে যেতে পারে। দর্শকেরা দেখতে পেল শিশু দুটিকে উদ্ধার করার জন্যে দুই পাশ থেকে দুজন বিশাল মানুষ এগিয়ে আসছে–কিন্তু তারা কাছে আসতে পারছে না। কারণ র্যাকটি বিপজ্জনকভাবে দুলছে। কেউ জানতেও পারল না পাহাড়ের মতো এই দুটি মানুষ আসলে বাচ্চা দুটিকে উদ্ধার করতে আসছে না–র্যাকটি তালে তালে দুলিয়ে বাচ্চা দুটিকে উপর থেকে ফেলে খুন করার চেষ্টা করছে।