মহিলাটি বলল, “আপনাদের সেই অবিশ্বাস দূর করার জন্যে এই খাঁচার ভেতরে আমরা স্প্রে পেইন্ট করব–অদৃশ্য মানুষের শরীরে সেই ক্ষণস্থায়ী পেইন্ট থেকে আপনারা তাকে দেখবেন–সবচেয়ে ভয়ংকর সবচেয়ে আশ্চর্য এবং সবচেয়ে বিচিত্র এক অদৃশ্য দানব।”
জোরে জোরে বাজনা বাজতে থাকে তখন সুসজ্জিত কিছু মানুষ বাজনার তালে তালে এসে প্রবেশ করে। তাদের পিঠে ব্যাকপেকে পেইন্ট, হাতে স্প্রে করার টিউব। খাঁচার কাছাকাছি এসে তারা ভেতরে উজ্জ্বল লাল রঙের স্প্রে করতে থাকে। হাজার হাজার দর্শক তখন অবাক হয়ে দেখে খাঁচার ভেতরে রক্তের মতো লাল একটি অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সেই বিচিত্র অবয়ব নড়ছে, ঝাঁঝালো কটু গন্ধের স্প্রে থেকে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে! বাইরে থেকে শেকলে হ্যাঁচকা টান দিতেই সেই বিচিত্র অবয়বটি সোজা হয়ে দাঁড়াল–লাল রঙের পেইন্টে ঢাকা বিচিত্র ভয়ংকর একটি মূর্তি। হাজার হাজার দর্শক কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে তারপর বিস্ময়ের একটা ধ্বনি করে প্রচণ্ড হাততালিতে পুরো হলঘরটিকে কাঁপিয়ে দেয়।
কেউ জানতেও পারল না যে-ভয়ংকর অদৃশ্য দানবকে দেখে সবাই ভয়ে আতঙ্কে শিউরে উঠেছে, শিকল-বাঁধা অবস্থায় যাকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়েছে সেই দানবটি আসলে ছিল একটি অত্যন্ত দুঃখী প্রাণী–গভীর কষ্টে তখন তার বুকটি ভেঙে যাচ্ছিল। তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধের উজ্জ্বল লাল রঙের পেইন্ট ছাপিয়ে তার চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি বের হয়ে আসছিল, কিন্তু কোনো মানুষ তার চোখের সেই অশ্রু দেখতে পাচ্ছিল না।
.
মন্তাজ ওস্তাদ সিগারেটটা পায়ে পিষে বলল, “তা হলে আমার প্ল্যানটা বুঝতে পেরেছিস তো?”
“বুঝেছি ওস্তাদ।”
“ব্যাক স্ক্রিনের মইটা দিয়ে দুইজনকে স্টেজের উপরে তুলে দে। স্টেজ থেকে কমপক্ষে তিরিশ ফুট। তারপর ভয় দেখিয়ে বল স্পটলাইটের র্যাকটা দিয়ে স্টেজের মাঝামাঝি যেতে। দরকার হলে ভয় দেখা।”
কালাচান দাঁত বের করে মিহি গলায় বলল, “ওইটা কোনো ব্যাপারই না।”
“তারপর আমরা ভান করব তাদের উদ্ধার করার চেষ্টা করছি। করব উলটোটা, ঝাঁকিয়ে উপর থেকে নিচে ফেলে দেব। খাঁচার ধারালো শিকে গেঁথে যাবে দুইজন। বুঝলি?”
“একেবারে পানির মতন।”
“যা তা হলে। দেরি করিস না।”
কালাচান আর দবির মিয়া হেঁটে হেঁটে জঞ্জাল রাখার ছোট ঘরটার কাছে গিয়ে সাবধানে ছিটকিনি খুলে ভিতরে উঁকি দিল। টুশির শরীরে হেলান দিয়ে তপু বসে ছিল, দরজা খুলতেই দুজনেই সোজা হয়ে বসল। দবির মিয়া তার গরিলার মতো ভারী শরীরটা ঘরের ভেতরে অর্ধেক ঢুকিয়ে হাত নেড়ে বলল, “আয়।”
টুশি দাঁড়িয়ে বলল, “কোথায়?”
“নিজেরাই দেখবি কোথায়।”
টুশি আর তপু তবুও অনিশ্চিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল, তখন দবির মিয়া ভিতরে ঢুকে খপ করে দুইজনের ঘাড় ধরে টেনে বাইরে নিয়ে এসে বলল, “তোদের সাহস খুব বেশি বেড়েছে?”
টুশি জিজ্ঞেস করল, “তোমরা আমাদের কী করবে?”
কালাচান মিহি গলায় বলল, “ছেড়ে দেব। কিন্তু তার আগে তোদের একটু শিক্ষা দিতে চাই।”
টুশি ভয়ে ভয়ে বলল, “কী শিক্ষা?”
“এমন শিক্ষা যেন জীবনে আর আমাদের সাথে তেড়িবেড়ি না করিস।”
তপু ভয়ে ভয়ে বলল, “কে-কেমন করে?”
তপুর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে টুশি আর তপুর ঘাড় ধরে কালাচান আর দবির মিয়া ততক্ষণে তাদেরকে স্টেজের পেছনে মইটার কাছে দাঁড় করিয়েছে। দুজনের চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, এই মইটা দিয়ে উপরে উঠে যাবি, তারপর ঐ যে র্যাকটা দেখছিস সেইটার উপর দিয়ে স্টেজের ঠিক মাঝখানে চলে যাবি।
টুশি উপরে তাকিয়ে আঁতকে উঠে বলল, “সর্বনাশ! যদি পড়ে যাই?”
“সেইটাই তোদের শাস্তি। পড়তে পারবি না, পড়ে গেলে নিচের শিকে গেঁথে মরে যাবি। বুঝেছিস?”
তপু মাথা নেড়ে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, “আমি পা-পারব না।”
কালাচান কোমর থেকে একটা রিভলবার বের করে তপুর মাথায় ধরে বলল, “না পারলে এখানেই খুন করে ফেলব হারামজাদার বাচ্চা।”
তপু কেঁদে ফেলতে গিয়ে থেমে গেল, হঠাৎ করে সে বুঝতে পারল এদের সামনে কেঁদে কোনো লাভ নেই। এরা দয়ামায়াহীন পশু।
কালাচান টুশির ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে মইয়ের উপরে ফেলে দিয়ে বলল, “ওঠ।”
দবির মিয়া বলল, “ঐ র্যাক থেকে সবগুলো লাইট জ্বলছে–জায়গাটা আগুনের মতো গরম। ঐ গরমে এক ঘণ্টা বসে থাকবি, সেইটা হচ্ছে তোদের শাস্তি।”
কালাচান মিহি গলায় বলল, “এখন বল, তোরা কী চাস? এখানেই খুন হয়ে যেতে চাস নাকি ঐ র্যাকে বসে এক ঘণ্টা শাস্তি ভোগ করতে চাস?”
টুশি বলল, “তারপর আমাদের ছেড়ে দেবে?”
কালাচান মিহি গলায় বলল, “ছেড়ে না দিয়ে কী করব? তোদেরকে কি আমরা সারাজীবন পালব নাকি?”
দবির মিয়া বলল, “লাথি মেরে বিদায় করব যেন আর কখনও আমাদের সাথে লাগতে না আসিস।”
তপু উপরে তাকিয়ে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল “আমার ভয় করছে আপু।”
টুশি মুখে সাহসের একটা ভাব করে বলল, “ভয়ের কী আছে? আমি তোকে ধরে রাখব, আয়।”
কালাচান রিভলবার দিয়ে তপুর পিঠে একটা পুঁতো দিয়ে বলল, “ওঠ।”
তখন প্রথমে তপু তার পিছুপিছু টুশি মই দিয়ে উপরে উঠতে থাকে। প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচুতে গিয়ে তারা র্যাকটার নাগাল পেল। অ্যালুমিনিয়ামের সরু একটা ব্ল্যাক, তার সাথে ব্র্যাকেট লাগানো এবং সেই ব্র্যাকেট থেকে ফ্লাডলাইটগুলো ঝুলছে। তীব্র উজ্জ্বল আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে যায়, তার ভেতর থেকে আগুনের হলকার মতো গরম বাতাস আসছে–টুশি আর তপুর মনে হতে থাকে তারা বুঝি গরমে সেদ্ধ হয়ে যাবে।