তপু উত্তেজিত হয়ে বলল, “না মা-মা-মাগারুফাস”
হঠাৎ করে সে নার্ভাস হয়ে যায় এবং বুঝতে পারে সে কোননাভাবেই এখন আর এই ছোট কথাটা ঠিক করে উচ্চারণ করতে পারবে না। তার পরও সে প্রাণপণে চেষ্টা করল, বলল, “তোমাকে মা-মা-মাত্র তিনবার বলতে হবে। বলবে মা-মা-মাগারুফাস-” আবার তার মুখে কথাটা আটকে গেল। রাগে-দুঃখে তপুর চোখে পানি এসে যায়, সে মেঝেতে পা দাপিয়ে বলল, “আমি ঠি-ঠি-ঠিক করে বলতে পা-পারছি না। মা-মা-মা “
কাবিল বলল, “নার্ভাস হওয়ার কিছু নাই তপু। তুমি ঠাণ্ডা মাথায় আস্তে আস্তে বলো। কোনো তাড়াহুড়া নাই–
তপু বড় করে একটা নিশ্বাস নিল। চোখ বন্ধ করে মনে-মনে সে শব্দটা ঠিক করে উচ্চারণ করল। তখন সে চোখ খুলে যেই বলতে শুরু করল ঠিক তখন দুই পাশ থেকে দুইজন খপ করে ধরে এক হ্যাঁচকা টানে তাকে শূন্যে তুলে ফেলে বলল, “পেয়েছি!”
তপু চিৎকার করতে যাচ্ছিল, কিন্তু কে যেন তার মুখটা খপ করে ধরে ফেলল, সে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্যে ছটফট করতে থাকে কিন্তু কোনো লাভ হয় না। যারা তাকে ধরেছে তাদের হাত লোহার মতো শক্ত, গায়ে মোষের মতো জোর।
তপু তাকিয়ে দেখল, টুশিকেও মন্তাজ ওস্তাদ ধরে রেখেছে। টুশি তার মাঝেই তপুকে দেখে উত্তেজিত হয়ে বলল, “তপু–বলেছিস?”
তপু মাথা নেড়ে বলল, “না আপু। বলতে পা-পারি নি।”
টুশির মুখটা মুহূর্তে বিবর্ণ হয়ে গেল। বলল, “পারিস নি?”
তপুর চোখে পানি এসে যায়। মাথা নিচু করে বলল, চে-চেষ্টা করেছিলাম। মু মুখে আটকে গেল।”
তপু মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, “এখন কী হবে আপু?” টুশি কোনো কথা না বলে তপুর দিকে তাকিয়ে রইল। সত্যিই তো–এখন কী হবে?
১৫. বিপত্তি
মন্তাজ ওস্তাদ ছোট গ্রিনরুমটার একপাশ থেকে অন্য পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “ফিনিশ করে দিতে হবে।”
দবির মিয়া তার ঘাড়বিহীন মাথা নাড়ল, বলল, “জে ওস্তাদ। ফিনিশ করে দিতে হবে।”
“একেবারে ফিনিশ না করলে বিপদ। এইটুকুন দুইটা পিচ্চি কিন্তু কী ডেঞ্জারাস . দেখেছিস?”
কালাচান মিহি গলায় বলল, “অসম্ভব ডেঞ্জারাস।”
দবির মিয়া বলল, “কীভাবে ফিনিশ করবেন ওস্তাদ? গুল্লি?”
“উঁহু।” মন্তাজ ওস্তাদ খুব চিন্তিত মুখে বলল, “এমনভাবে ফিনিশ করতে হবে যেন কেউ সন্দেহ না করে।”
কালাচান বলল, “সেইটা কীরকম?”
“দেখে যেন মনে হয় অ্যাক্সিডেন্ট।” “অ্যাক্সিডেন্ট?”
“হ্যাঁ।” মন্তাজ ওস্তাদ বলল, “এইখানে আজকে যারা শো করছে তারা আসল জিনিস জানে না। আসল জিনিস জানি খালি আমরা কয়েকজন। আর জানে এই দুই পিচ্চি। আসল জিনিস জানাজানি হয়ে গেলে কিন্তু আমরা কোনো বিজনেস করতে পারব না।”
কালাচান আর দবির মিয়া একসাথে মাথা নাড়ল।
“কাজেই এমনভাবে এই দুই পিচ্চিরে মার্ডার করতে হবে যেন কেউ বুঝতে না পারে। সবাই যেন মনে করে অ্যাক্সিডেন্ট।”
“সেইটা কীভাবে করবে ওস্তাদ?”
“এই স্টেজে করতে হবে। সবার সামনে। আজকেই।”
“আজকেই?”
“হ্যাঁ। শো শুরু হলেই।”
কালাচান আর দবির মিয়া মাথা চুলকে বলল, “কীভাবে করবে ওস্তাদ?”
“দেখি–আমাকে একটু চিন্তা করতে দে।” মন্তাজ ওস্তাদ তার ফোকলা দাঁত দিয়ে পিচিক করে একবার থুতু ফেলে একটা সিগারেট ধরাল। কালাচান আর দবির মিয়া ধৈর্য ধরে ওস্তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে রইল।
.
ঠিক এই সময়ে টুশি আর তপু ছোট একটা ঘরে একটা প্যাকিংবাক্সের উপর বসে ছিল। ঘরটিতে কোনো জানালা নেই–নানারকম জঞ্জালে ভরতি। উপরে একটা উজ্জ্বল বাতি জ্বলছে, সেই আলোতে জঞ্জালভরা এই নোংরা ঘরটাকে দেখে কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যায়। তপু বলল, “টু-টুশি আপু, এখন কী হবে?”
টুশির নিজেরও খুব ভয় করছিল, কী হবে সে জানে না, এই মানুষগুলো এত খারাপ যে ভয়ংকর কিছু হতে পারে। টুশি অবশ্যি সেটা তপুকে বুঝতে দিল না। বলল, “কী আর হবে, আমাদেরকে কিছুক্ষণ আটকে রেখে ছেড়ে দেবে।”
“য-যদি না দেয়?”
প্রশ্নটা খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন, কিন্তু টুশি হাত নেড়ে উড়িয়ে দিয়ে বলল, “না দেবে কেন? কাবিল কোহকাফীর অনুষ্ঠান শেষ হলেই আমাদেরকে ছেড়ে দেবে।”
তপু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আর কা-কাবিল কোহকাফীর কী হবে?”
টুশি একটা নিশ্বাস ফেলল, বলল, “দেখিস আমরা ঠিক চিন্তা করে একটা বুদ্ধি বের করে ফেলব।”
ঠিক এই সময়ে তারা খুব জোরে জোরে একটা বাজনার শব্দ শুনতে পেল, তার সাথে প্রচণ্ড হাততালি। টুশি বলল, “নিশ্চয়ই পরদা তুলেছে।”
.
টুশির ধারণা সত্যি। ঠিক তখন বিশাল লাল ভেলভেটের পরদা টেনে সরিয়ে দেয়া হয়েছে, ভেতরে আলো-আঁধারের খেলা। স্টেজে গাছপালা এবং পুরনো একটা প্রাসাদের মতো একটা সেট। মাঝখানে কালো কাপড়ে ঢাকা একটা লোহার খাঁচা। ঠিক তখন দুই পাশ থেকে দুজন ছুটে স্টেজে এল, একজন পুরুষ অন্যজন মহিলা। তারা মাথা নুইয়ে অভিভাদন করে বলল, “পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্ময়কর সবচেয়ে বিচিত্র এবং সবচেয়ে ভয়ংকর অনুষ্ঠানে আপনাদের সবাইকে আমন্ত্রণ। আপনারা এখন দেখবেন সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে অভাবনীয় সৃষ্টি। অদৃশ্য দানব।”
সবার প্রচণ্ড হাততালির শব্দের মাঝে দুজন কালো পরদাটা সরিয়ে নিতেই বিস্ময়করভাবে সবার হাততালি থেমে গেল কারণ খাঁচার ভিতরে কিছু নেই, শুধু কয়েকটি শিকল ঝুলছে। পুরুষমানুষটি বলল, “আপনারা ভাবছেন এখানে কি সত্যিই কেউ আছে? আমরা যদি দেখতেই না পাই তা হলে বিশ্বাস করব কেমন করে?”