টুশি তপুর ঘাড়ে হাত রেখে নরম গলায় বলল, “ভয়ের কী আছে? কুলহু আল্লাহ্ পড়ে বুকে একটা ফুঁ দে দেখবি ভয় চলে যাবে।”
তপু বিড়বিড় করে কুলহু আল্লাহ্ পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে স্টেজের দিকে এগুতে থাকে। সামনে এখনও কিছু মানুষ হাঁটাহাটি করছে। কাজেই আলাদা করে কেউ তাদের লক্ষ করল না। উইংসের সামনে একজন মানুষ পাহারা দিচ্ছে, মানুষটি দুইজন দর্শককে কী-একটা বোঝাচ্ছে, সেই ফাঁকে টুশি আর তপু চট করে ভিতরে ঢুকে গেল। বিশাল একটা উইংস তার পিছনে আবছা অন্ধকার, সেখানে নিজেদের আড়াল করে রেখে তারা একটা নিশ্বাস ফেলল।
উইংসের আড়াল থেকে স্টেজটাকে দেখে তারা হতবাক হয়ে যায়। বিশাল স্টেজ তার মাঝামাঝি একটা বড় খাঁচা, সেটা কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা। কাবিল কোহকাফীকে নিশ্চয়ই এর ভেতরে বেঁধে রাখা আছে। খাঁচার দুই পাশে খুব জমকালো সেট তৈরি করা হয়েছে। দেখে মনে হয় সেটা বুঝি বিশাল একটি অরণ্য। তার পিছনে প্রাসাদের মতো একটা ঘর–দেখে মনে হয় পুরোটা বুঝি একটা রূপকথার রাজ্য। পেছনে বিশাল স্ক্রিনে বড় বড় করে লেখা–
পৃথিবীর এক এবং অদ্বিতীয়
সবচেয়ে আশ্চর্য এবং সবচেয়ে ভয়ংকর
অদৃশ্য দানব!
স্টেজের দুই পাশে বিশাল কিছু স্পিকার, একেবারে ছাদ পর্যন্ত চলে গেছে। বেশ কয়েকজন মানুষ মিলে সেগুলো পরীক্ষা করছে। মাঝে মাঝেই সেগুলো গুম গুম শব্দ করছে, মনে হয় শব্দে ছাদ ধসে পড়বে। স্টেজের জন্যে নানারকম আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে, নানা রঙের স্পটলাইট ঝুলছে, স্টেজের দুই পাশেও অনেক মানুষ বড় বড় স্পটলাইট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মাঝে মাঝে লাইট জ্বলছে এবং নিভছে। সুন্দর সুন্দর কাপড় পরা সেজেগুজে থাকা কয়েকজন পুরুষ এবং মহিলা খুব ব্যস্ত হয়ে স্টেজের উপর হাঁটাহাঁটি করছে। তারা নিশ্চয়ই অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করবে। টুশি এবং তপু অবাক হয়ে এই ব্যস্ততা এবং হইচই দেখতে থাকে, এত মানুষের ভিড়ের মাঝে কোথাও তারা মন্তাজ ওস্তাদ কালাচান কিংবা দবির মিয়াকে দেখতে পেল না। তারা হচ্ছে গুণ্ডা এবং সন্ত্রাসী, এই অনুষ্ঠানে সেজন্যে তারা নেই, হয়তো গ্রিনরুমে কোথাও বসে আছে।
তপু জিজ্ঞেস করল, “আপু এখন কী-ক-করব?”
টুশি স্টেজটা ভালো করে পরীক্ষা করে ফিসফিস করে বলল, “প্রথমে লুকিয়ে এক দৌড়ে ঐ সেটের পিছনে যেতে হবে। তা হলে কেউ দেখতে পাবে না। তারপর সেটের পিছন দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে খাঁচার কাছে যাব।”
তপু বলল, “যদি ধ-ধ-ধরা পড়ে যাই?”
“ধুর গাধা! ধরা পড়বি কেন?” টুশি তপুকে সাহস দিয়ে বলল, “লাইটটা যখন কমাবে তখন মাথা নিচু করে একটা দৌড় দিবি। সোজা সেটার দিকে।”
“তু-তুমি আসবে না?”
“আসব কিন্তু একসাথে না। দুইজন আলাদা আলাদা, যেন ধরা পড়লেও একজন ধরা পড়ি। বুঝেছিস?”
তপু বলল, “বু-বুঝেছি।”
দূজন কয়েক মিনিট নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল, স্টেজের লাইটিং পরীক্ষা করতে করতে একসময় আলোগুলো নিবুনিবু করেছে তখন টুশি তপুর পিঠে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, “যা।”
তপু তখন নিচু হয়ে একছুটে উইংস থেকে একটা বিশাল কার্ডবোর্ডের গাছের নিচে আড়াল হয়ে গেল। টুশি কয়েক মুহূর্ত নিশ্বাস বন্ধ করে থাকে কেউ দেখতে পায় নি। টুশি যদি নাও যেতে পারে কিংবা ধরাও পড়ে যায় তা হলেও এখন ক্ষতি নেই, তপু হামাগুড়ি দিয়ে কাবিল কোহকাফীর কাছে পৌঁছে যেতে পারবে।
টুশি আরও কয়েক মিনিট অপেক্ষা করল, আবার যখন স্পটলাইটের আলোটা ঘুরে অন্যদিকে চলে গেল টুশি মাথা নিচু করে একছুটে সেটের আড়ালে চলে গেল তাকেও কেউ দেখতে পায় নি। টুশি কিছুক্ষণ বড় বড় নিশ্বাস নেয় তারপর হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে থাকে, ঠিক তখন একটা বিপর্যয় ঘটে গেল।
স্টেটাকে সাজানোর জন্যে যে বড় বড় সেট তৈরি করা হয়েছে সেগুলো কাঠের ফ্রেম ব্যবহার করে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে। দেখে সেগুলোকে বিশাল বড় মনে হলেও আসলে এগুলো তৈরি হালকা কার্ডবোর্ড দিয়ে। টুশি সেটা বুঝতে পারে নি-পিছন থেকে একটার ওপর হালকাভাবে হেলান দিতেই তাকে নিয়ে পুরোটা হুড়মুড় করে স্টেজের ওপর পড়ে গেল–সাথে সাথে হইচই চেঁচামেচি চিৎকার শুরু হয়ে যায়। টুশি শুনতে পেল, একজন বলল, “বাবারে গেছিরে!”
কয়েকজন দৌড়ে এল তার কাছে। একজন জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? কেমন করে পড়ল?”
যার মাথার উপর পড়েছে সে কোকাতে কোকাতে বলল, “জানি না। এত করে বললাম শক্ত করে পেরেক মার–”
“মেরেছি তো শক্ত করে।”
অন্যজন ধমক দিয়ে বলল, “শক্ত করে মারলে এইভাবে মাথার মাঝে খুলে পড়ে?”
আরেকজন বলল, “পিছনে গিয়ে দ্যাখ কী হয়েছে।”
টুশি বুঝতে পারল কয়েকজন মানুষ ব্যাপারটা দেখতে আসছে। সে তাড়াতাড়ি অন্য একটা কার্ডবোর্ডের গাছের আড়ালে লুকানোর চেষ্টা করছিল কিন্তু তার আগেই একজন তাকে দেখে চিৎকার করে বলল, “আরে! আরে! এইখানে এই মেয়ে কোথা থেকে এসেছে?”
টুশি ধরা পড়ে গেছে বুঝতে পেরে কিছুই হয় নি এরকম ভান করে তার ফ্রক ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে এল। লিকলিকে চিকন একজন মানুষ খপ করে তার হাত ধরে বলল, “এই মেয়ে? তুমি এখানে কী করছ?”
টুশি গলার স্বর যতটুকু সম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল, “আমার ইঁদুরের বাচ্চা–”
‘ইঁদুরের বাচ্চা?”
“হ্যাঁ, আমার পোষা একটা ইঁদুরের বাচ্চা আছে। হঠাৎ হাত থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে গেল। এদিকে কোথায় জানি লুকিয়েছে।”