টুশি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, যদি খুব সুইট একটা ভূত এসে বলে, তুমি কী চাও? তা হলে আমি কী বলব জান?”
নানা বললেন, “না, জানি না। কী বলবি?”
“বলব, আমার চেহারাটা সুন্দর করে দাও। এমন সুন্দর করে দাও যেন যে-ই দেখে সে-ই ট্যারা হয়ে যায়।”
নানা টুশির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “তোর চেহারা এমনিতেই খুব সুন্দর আছে”
“ছাই আছে, কচু আছে।” টুশি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ভূত যদি তোমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে তুমি কী চাও, তা হলে তুমি কী বলবে নানা?”
“আমি? আমি বলব আমার নাতনির যে গরম মেজাজ সেটাকে ঠাণ্ডা করে দাও–যেন সে দিনরাত ক্যাট ক্যাট ক্যাট ক্যাট না করে!”
টুশি নানাকে একটা ছোট ধাক্কা দিয়ে বলল, “বাজে কথা বলো না, আমার মেজাজ মোটেও গরম না–আমি মোটেও দিনরাত ক্যাট ক্যাট করি না। ঠিক করে বলো তুমি কী চাইবে। প্লিজ।”
নানা দাড়ি চুলকালেন তারপর মাথা চুলকালেন তারপর বললেন, “আমি বলব, আমার নাতনি টুশি যেন খুব ভালো একটা ফ্যামিলিতে বড় হতে পারে–যে ফ্যামিলি তাকে একেবারে নিজের বাচ্চার মতো করে দেখে। আমি তা-ই চাইব।”
টুশি তার নানার দিকে তাকাল, তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “না, নানা। সেটা হবে না। আমি কোনো ফ্যামিলির সাথে থাকব না। আমি থাকব তোমার সাথে। তার মানে কী জান?”
“কী?”
“আমি যতদিন বড় না হচ্ছি তুমি মারা যেতে পারবে না।”
“মারা যেতে পারব না?”
“না।”
নানা হাসি গোপন করে বললেন, “এটা কি তোর আদেশ।”
“হ্যাঁ আমার আদেশ।”
.
টুশির এরকম কঠিন একটা আদেশ দিয়েও অবশ্যি লাভ হল না। তার নানা এক বছরের মাথায় মারা গেলেন, টুশিকে যেতে হল তার নানার ঠিক করে রাখা পরিবারটির সাথে। যেদিন এই বড় বাড়িটি ছেড়ে যাচ্ছিল সেদিন জানালায় মাথা রেখে খুব কাঁদল টুশি। তারপর চোখ মুছে তার ছোট ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বের হয়ে এল। ঘর থেকে বের হবার সময় কী মনে করে টেবিল থেকে ছোট বিচিত্র আকারের কালচে রঙের বোতলটা নিয়ে নিল টুশি।
আমাদের কাহিনী শুরু হল সেই থেকে।
০২. নূতন পরিবার
টুশি যে-পরিবারটির সাথে থাকতে গেল তারা কীভাবে কীভাবে জানি টুশির আত্মীয় হয়। নানা ধরনের হিসাব করে সঠিক সম্পর্কটা বের করে ফেলা যায়, কিন্তু টুশি এত ঝামেলার মাঝে গেল না, ভদ্রলোককে ডাকল চাচা এবং তার স্ত্রীকে ডাকল চাচি। টুশির এই নূতন চাচা-চাচি যে খুব আগ্রহ নিয়ে টুশিকে নিজেদের কাছে এনে রেখেছেন সেটা ঠিক নয়। টুশির সাথে দুজনেই মোটামুটি একধরনের ভদ্রতা বজায় রেখেছেন, কিন্তু এর মাঝে কোনো আন্তরিকতা নেই–টুশি খুব সহজে সেটা ধরে ফেলল। টুশির যেন টাকাপয়সা নিয়ে সমস্যা না হয় সেজন্যে মারা যাবার আগে নানা একটা ট্রাস্ট খুলে ব্যবস্থা করে গেছেন–এরকম একটা ব্যবস্থা করা না হলে এই পরিবারটি তাকে বাসায় এনে রাখতে রাজি হত কি না সেটা নিয়ে টুশির মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়।
টুশির নূতন চাচার নাম ইমতিয়াজ আহমেদ, মানুষটি মোটাসোটা গোলগাল, নাকের নিচে সিরাজদ্দৌলার মতো সরু গোঁফ। মোটাসোটা মানুষ সাধারণত হাসি খুশ হয়, কিন্তু ইমতিয়াজ আহমেদ গোমড়ামুখী মানুষ। কথা বলেন কম, হাসেন আরও কম। তাঁর স্ত্রী শায়লা আহমেদ মোটামুটি সুন্দরী মহিলা, হালকা পাতলা এবং একধরনের ধারালো চেহারা। ঠোঁট দুটো সরু বলে তাঁকে কেমন জানি অহংকারী দেখায়। তাঁদের একটামাত্র ছেলে, তার বয়স সাত এবং সে ক্লাস টুতে পড়ে। ছেলেটা মায়ের মতো ছিপছিপে, বড় বড় কৌতূহলী চোখ। প্রথম দিন চাচা-চাচি টুশিকে তাদের ছেলের ঘরে পরিচয় করিয়ে দিতে এনে বললেন, “তপু, এই যে তোমার নূতন আপু—“
তপু কোনো কথা না বলে কেমন জানি ভয়-পাওয়া চোখে একবার টুশির দিকে, একবার তার আব্ব আরেকবার তার আম্মুর দিকে তাকাল। ছেলেটার ভয় ভাঙানোর জন্যে টুশি একটু হাসার চেষ্টা করল, কিন্তু কোনো লাভ হল না। তখন তার আম্মু কঠিন একধরনের গলায় বললেন, “এই আপু তোমার ঘরে থাকবে। তুমি তোমার এই আপুকে বিরক্ত করবে না। ঠিক আছে?”
ছেলেটা সাথে সাথে মাথা নাড়ল, টুশি অবাক হয়ে বুঝতে পারল এই ছোট বাচ্চাটা তার বাবা-মাকে ভয় পায়। কী আশ্চর্য! টুশির যদি নিজের বাবা-মা থাকত তা হলে সে তাদের নিয়ে কী যে কাণ্ড করত সেটা কাউকে বোঝাতেও পারবে না। আর এই ছোট ছেলেটার নিজের বাবা-মা অথচ তাদেরকে ভয় পায়–কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার!
টুশিকে তপুর ঘরে রেখে বাবা-মা বের হয়ে যাবার সাথে সাথে টুশি ছেলেটার সাথে ভাব করার চেষ্টা করল। বলল, “আমাকে তোমার ঘরে থাকতে দেবে?”
ছেলেটা মাথা নাড়ল।
“আমাকে তোমার ভয় করবে না তো?”
ছেলেটা মাথা নেড়ে জানাল যে ভয় করবে না।
“আমার নাম তুমি জান?”
ছেলেটা মাথা নেড়ে জানাল সে জানে না এবং নামটা জানার জন্যে সে চোখেমুখে একটু কৌতূহল দেখাল।
“আমার নাম হচ্ছে টুশি। কেন আমার নাম টুশি তুমি জান?”
ছেলেটা আবার মাথা নেড়ে জানাল যে সে জানে না।
টুশি কবিতার ছন্দ করে বলল,
“আমি একজনকে মেরেছিলাম ঘুসি–
সেই জন্যে আমার নাম টুশি!”
এই প্রথমবার ছেলেটার মুখে হালকা একটু হাসি দেখা গেল। টুশি এবারে চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল “তোমার নাম কেন তপু জান?”
ছেলেটি মাথা নেড়ে জানাল সে জানে না কিন্তু কেন সেটা জানার আগ্রহ তার চোখে মুখে ফুটে উঠল। টুশি আবার কবিতার মতো ছন্দ করে বলল,