টুশি মাথা নাড়ল, “না।”
“অনেক ভালো।”
“হ্যাঁ। অনেক ভালো আর সুইট।”
তপু মুখ শক্ত করে জিজ্ঞেস করল, “তা হলে কেন লি-লিখেছে অনেক ভ ভয়ংকর? অনেক হি-হিংস্র?”
টুশি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমার মনে হয় কী জানিস? তাকে তো বেঁধে রেখেছে সেইজন্যে লিখেছে হিংস্র, লিখেছে রক্তপিপাসু। ভালো মানুষকে কি বেঁধে রাখা যায়?”
তপু বলল, “ঠি-ঠিক বলেছ।”
“তা ছাড়া হিংস্র বললে, কেউ কাছে আসবে না। বদমাইশগুলো নিশ্চয়ই চায় না কেউ কাছে আসুক। নিশ্চয়ই চায় সবাই দূর থেকে দেখুক।”
“ইশ! বেচারা কা-কাবিল কোহকাফী! এখন কী হবে?”
টুশি খুব দুশ্চিন্তিত মুখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “কিছু-একটা করতে হবে। সাহায্য করার জন্যে আমাদের যেতে হবে।”
“ কিন্তু কে-কেমন করে যাব? ক-কত টাকা টিকেট দেখেছ?”
“যত টাকাই হোক যেতে হবে।”
“টা-টাকা কোথায় পাবে?”
“আমার নানা ট্রাস্ট করে আমার জন্যে টাকা রেখে গেছে, সেখান থেকে নেব।”
তপু মুখ শুকনো করে বলল, “কিন্তু তা-তারপর কী হবে?”
টুশি বলল, “দেখি কী করা যায়। কিছু-একটা আমাদের করতেই হবে।”
.
রাত্রিবেলা টুশি আর তপু টেলিভিশনে অদৃশ্য-দানবের ওপর বিজ্ঞাপনটি দেখল। ছোট এক মিনিটের বিজ্ঞাপন। প্রথমে মন্তাজ ওস্তাদ কীভাবে সুন্দরবন অভিযানে গিয়ে সেখানে জলের ভেতর থেকে এই ভয়ংকর হিংস্র প্রাণীটা ধরেছে সেটা নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে দুই-একটা কথা বলল। তারপর একটা খচা নিয়ে আসা হল–তার ভেতরে নাকি অদৃশ্য দানব। তখন হিংস্র জন্তুর গর্জন শোনা যেতে লাগল, ভয়ের ছবিতে যেরকম ভূত-প্রেত-দানব দেখা যায় সেরকম ভয়ংকর কিছু দাপাদাপি করল, ভয়-পাওয়া মানুষের আতঙ্ক এবং চিৎকার শোনা গেল। তারপর একজন সুন্দরী মেয়ে এসে বলল, “এই আদিম ভয়ংকর রক্তপিপাসু হিংস্র দানবটিকে আপনারা দেখতে পারবেন প্রদর্শনী শোতে। এই দেখাঁটি আপনারা ভুলতে পারবেন না– কারণ প্রাণীটি অ-দৃশ্য!”
টুশি রিমোট চেপে টেলিভিশনটি বন্ধ করে দিয়ে বলল, “কত বড় বদমাইশ! কাবিল কোহকাফী হচ্ছে একটা সুইট জিন। আর তাকে বানিয়েছে হিংস্র দানব।”
“কেউ তো দে-দেখতে পায় না তাই।”
টুশি তপুর দিকে তাকিয়ে বলল, “যদি সবাই দেখতে পারত তা হলে আর কেউ বদমাইশি করতে পারত না।”
তপু টুশির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা যদি সেই ম-মন্ত্রটা খুঁজে বের করতে পারতাম!”
“কোন মন্ত্রটা?”
“যেটা বললে কা-কাবিলের বাণ কেটে যাবে!”
টুশি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সেটা আমরা কোথায় পাব! কত হাজার বছর আগের কথা!”
তপু টুশির দিকে তাকিয়ে বলল, “আপু।”
“কী হল?”
“তুমি ও-ওষুধের শিশি দেখেছ?”
“দেখেছি। কেন?”
“ওষুধের শি-শিশির উপরে স-সবসময় লেখা থাকে ক-কখন খেতে হয়, সেরকম তার বোতলটিতে কি কা-কাবিল কোহকাফীর উপর লে-লেখা আছে?”
টুশি বলল, “কিছু লেখা থাকলে কি চোখে পড়ত না?”
“কিন্তু আমরা তো ভা-ভালো করে দেখি নাই।”
টুশি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আয় তা হলে ভালো করে দেখি।”
টুশি আর তপু কাবিল কোহকাফীর শিশিটা বের করে খুব ভালো করে দেখল। শিশিটা মনে হয় পাথরের তৈরি, বেশ ভারী। ছিপিটা ভেঙে খোলা হয়েছে, সেটা মনে হয় কোনো একটা ধাতুর তৈরি। এত বছর পরেও ধাতুটিতে জং ধরে নি– কাজেই মনে হয় খুব ভালো কোনো ধাতু হবে! টুশি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে কোনোকিছু না পেয়ে তপুর হাতে দিল। তপু টেবিল-ল্যাম্পের নিচে ধরে ভালো করে দেখে হঠাৎ একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, “আ-আপু।”
“কী হয়েছে?”
“মনে হয় উপরে কিছু লেখা আছে–”।
“কোথায়?”
“এই দ্যাখো-খুব হালকা, বো-বোঝা যায় না এরকম।”
টুশিও এসে দেখল, খুব ভালো করে তাকালে মনে হয় সত্যিই কিছু-একটা লেখা আছে। খুব অস্পষ্ট লেখা। টুশি বলল, “মনে হয় এক হাজার বছরের ময়লা লেগে এই অবস্থা। পরিষ্কার করে নিই।”
“কী দিয়ে প-পরিষ্কার করবে আপু?”
“নেল পালিশ রিমুভার।”
ছোট একটা টিসু পেপারে চাচির নেলপালিশ রিমুভার লাগিয়ে টুশি পাথরের শিশিটা ঘষতেই বাদামি রঙের ময়লা উঠে নিচের লেখা পরিষ্কার বের হয়ে এল। তপু হাতে কিল দিয়ে বলল, “পেয়ে গেছি! লে-লেখা পেয়ে গেছি!”
টুশি বলল, “আগেই এত খুশি হয়ে যাস নে।”
“কেন?”
“লেখাটা আগে দ্যাখ।”
তপু দেখল এবং সমস্যাটা বুঝতে পারল। লেখাটি কোনো পরিচিত ভাষায় লেখা নয়। আরবির মতো–কিন্তু আরবি নয়। জিজ্ঞেস করল, “কী ভাষা এটা?”
“জানি না।”
“তা-তা হলে পড়ব কেমন করে?”
টুশি মাথা নেড়ে বলল, “সেটাও জানি না।”
দুজনে মিলে খানিকক্ষণ জল্পনা-কল্পনা করল। মসজিদের ইমাম সাহেবকে দিয়ে পড়িয়ে নেয়া যায় কি না আলোচনা করল কিন্তু তাতে কাজ হবে বলে মনে হয় না। ইউনিভার্সিটিতে অনেক জ্ঞানীগুণী থাকে তাদের কাছে নিয়ে গেলে হয়তো কেউ-একজন এটা পড়ে দিতে পারে কিন্তু সেখানে কার কাছে নিয়ে যাবে তারা। বুঝতে পারল না। মিউজিয়ামে নিয়ে যাওয়া যায়, সেখানকার কিউরেটর হয়তো বলতে পারবে। কিন্তু ছোট মানুষ বলে তাদের কোনো পাত্তা দেবে বলে মনে হয় না। লাইব্রেরিতে অনেক বইপত্র থাকে, সেখানে গিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে হয়তো এটা কোন ভাষা বের করে ফেলতে পারবে। কিন্তু সেই ভাষাটা শিখে ওপরের লেখাটা পড়তে পারবে বলে মনে হয় না। টুশি এবং তপু নূতন করে ছোট থাকার সমস্যাটা বুঝতে পারল, তারা যদি বড় মানুষ হত কিংবা কোনো একজন বড় মানুষের সাথে তাদের পরিচয় থাকত তা হলে হয়তো এই সমস্যাটার সমাধান বের করে ফেলত। যখন দুজনে প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিল তখন তপু চোখ বড় বড় করে বলল, “আপু”।