কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। কালাচান এবং দবির মিয়া হঠাৎ করে একসাথে কোথা থেকে দুটি রঙের ক্যান বের করে আনে, কিছু বোঝার আগে তারা নিখুঁতভাবে কাবিলের দিকে লক্ষ্য করে সেই রঙের ক্যানে চাপ দিয়ে রং স্প্রে করে দেয়। টুশি অবাক হয়ে দেখল মুহর্তে কাবিলের সারা মুখ হাত-পা স্প্রে ক্যানের রঙে। মাখামাখি হয়ে গেল। সাথে সাথে মন্তাজ ওস্তাদ টুশিকে ধাক্কা দিয়ে রিভলবারটা কাবিলের দিকে ধরে বলল, “কাবিল কোহকাফী, তুমি মানুষটা অদৃশ্য হতে পার– কিন্তু তোমার চোখে-মুখে হাতে যে রং লেগেছে সেটা আমরা দেখছি! একটু নড়লেই তোমাকে আমি গুলি করব।”
কাবিল তার পরেও নড়ার চেষ্টা করল কিন্তু ততক্ষণে কালাচান এবং দবির মিয়া দুইপাশ থেকে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
টুশি এবং তপু গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকে কিন্তু তার ভিতরে তিনজন মিলে কাবিল কোহকাফীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল।
টুশি খোলা দরজা দিয়ে বাইরে ছুটে যেতে চাইছিল কিন্তু দবির মিয়া তাকে ধরে ফেলল। কিছু বোঝার আগে তপু এবং টুশি এই দুজনকেও দুটি চেয়ারে বেঁধে ওদের মুখে মন্তাজ ওস্তাদ সার্জিক্যাল টেপ লাগিয়ে দিল। ঘরের হুটোপুটি শুনে বাইরে কেউ এসেছে কি না সেটা সাবধানে পরীক্ষা করে, পকেট থেকে অ্যালকোহলের বোতল বের করে তুলো দিয়ে ভিজিয়ে কাবিল কোহকাফীর চোখ মুখের সব রং মুছে নেয়। তাকে পুরোপুরি অদৃশ্য করে মানুষ তিনজন যেভাবে এসেছিল সেভাবে এবারে নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
.
সন্ধেবেলা চাচা-চাচি বাসায় এসে আবিষ্কার করলেন ঘর-বোঝাই মুড়ি এবং তার মাঝে টুশি এবং তপু চেয়ারে বাঁধা। তারা ছুটে এসে তাদের খুলে দিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে?”
টুশি কিছু বলল না। তপু কঠিন মুখে তার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার বন্ধুরা এসেছিল আব্দু।”
চাচা অবাক হয়ে বললেন, “আমার বন্ধুরা?”
“হ্যাঁ। সেদিন যে তিনজনকে আমরা ধরেছিলাম তারা আজকে আবার এসেছে। বলেছে তারা তোমার বন্ধু।”
চাচার মুখ হাঁ হয়ে গেল, তোতলাতে তোতলাতে বললেন, “ম-ম-মন্তাজ ওস্তাদ?”
তপু এতটুকু তোতলাল না, বলল, “হ্যাঁ। তারা বলেছে তুমি তাদেরকে পুলিশে দেও নাই।”
চাচা তোতলাতে তোতলাতে বললেন, “কে-কে-কেন এসেছিল?”
তপু বলল, “আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছ? তোমার বন্ধুদের তুমি কেন জিজ্ঞেস কর না?”
টুশি অবাক হয়ে তপুর দিকে তাকিয়ে রইল, তার কথায় তোতলামির কোনো চিহ্ন নেই।
চাচা কিছু-একটা বলার চেষ্টা করছেন–কিন্তু ঠিক বলতে পারছেন না, টুশি সেটা শোনার চেষ্টাও করছে না।
তার শুধু কাবিল কোহকাফীর কথা মনে পড়ছে। কোথায় আছে কাবিল কোহকাফী? কেমন আছে কাবিল কোহকাফী?
১৩. পরিকল্পনা
পরের দুই সপ্তাহে টুশি এবং তপু খুব বড় একটা জিনিস আবিষ্কার করল, সেটা হচ্ছে। পৃথিবীর সব মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগের নাম হচ্ছে ছোট মানুষ, অন্য ভাগের নাম হচ্ছে বড় মানুষ। ছোট মানুষদের বড় মানুষের সব কথা শুনতে হয় কিন্তু বড় মানুষেরা ছোট মানুষের কোনো কথাই শোনে না।
কাবিল কোহকাফীকে ধরে নিয়ে যাবার পর কী করবে বুঝতে না পেরে টুশি আর তপু অনেক চিন্তাভাবনা করে একদিন পুলিশকে ফোন করল। মোটা গলার স্বরে একটা মানুষ বলল, “হ্যালো।”
টুশি বলল, “এটা কি পুলিশের অফিস?”
মোটা গলার মানুষটা বলল, “কার সাথে কথা বলতে চাও খুকি?”
“পুলিশের সাথে।”
মোটা গলার মানুষটি তখন একটা ঢেকুর তুলল। তুলে বলল, “কেন কথা বলতে চাও?”
টুশি বলল, “একজন মানুষ কিডন্যাপ হয়েছে সেটা রিপোর্ট করতে চাই।”
টুশি ভেবেছিল সেটা শুনে পুলিশ অফিসার চমকে উঠে বলবে, “কে কিডন্যাপ হয়েছে? কখন কিডন্যাপ হয়েছে? কীভাবে কিডন্যাপ হয়েছে?” কিন্তু সেরকম কিছু হল না, মানুষটা এবারে আরেকটা ঢেকুর তুলে বলল, “ও আচ্ছা। বেশ বেশ। খুকি এখন তো আমরা খুব ব্যস্ত–তুমি পরে ফোন কর।”
টুশি অবাক হয়ে বলল, “পরে ফোন করব?”
“হ্যাঁ। তুমি না করে তোমার আব্বাকে ফোন করতে বলো। ঠিক আছে? আর খুকি–এখন যাও, তুমি পড়াশোনা করতে যাও।”
টুশি টেলিফোনটা রেখে কিছুক্ষণ দাঁত কিড়মিড় করে ঘরের ভেতর পা দাপদাপি করল। তপু বলল, “টুশি আপু, প-পত্রিকায় ফোন করো।
তখন খবরের কাগজ দেখে টেলিফোন নাম্বার বের টুশি সেখানে ফোন করল। পুলিশের ওখানে ফোন ধরেছিল খুব মোটা গলার একজন পুরুষমানুষ। এখানে ফোন ধরল খুব মধুর গলার একজন মেয়ে, বলল, “হ্যালো।”
টুশি বলল, “আমরা একটা কিডন্যাপ রিপোর্ট করতে চাই।”
“ভেরি গুড। খুকি তুমি একটু ধরো।”
এরপর কিছুক্ষণ বাজনা শোনা গেল তারপর একজন মানুষ নাকি গলায় বলল, “এ্যালো। ছোটদের পাতা–”
“আমরা একটা কিডন্যাপ রিপোর্ট করতে চাই।”
মানুষটা নাকি গলায় বলল, “বেরি গুঁড। বেঁরি গুঁড। এ ফোর কাগজে ডাবল স্পেস দিয়ে লিখে পাঠিয়ে দাও।”
“লিখে পাঠিয়ে দেব?”
“এ্যা। সুন্দর দেখে একটা নাম দিও। কিডন্যাপারের শাস্তি। কিংবা দুষ্ট কিডন্যাপার। ইচ্ছা করলে একটা উঁড়াও দিতে পার।”
“ছড়া?”
“এ্যা। বিও পাঠাতে পার। রঙিন জেঁয়োন দিয়ে আঁকবে। বেরি গুঁড।”
টুশি আমতা-আমতা করে বলল, “আমরা ছড়া কিংবা ছবি পাঠাতে চাই না। সত্যিকারের একটা কিডন্যাপ হয়েছে সেটা রিপোর্ট করতে চাই। আপনাদের পত্রিকায় সেটা ছাপাবেন।”