কালাচান মিহি গলায় বলল, “সতুর বছরের এক বুড়ির কাছ থেকে এইরকম ধোলাই খেয়েছি–খবরটা ছড়িয়ে গেলে কি আমাদের বিজনেস থাকবে?”
দবির মিয়া বলল, “যদি ইমতিয়াজ সাহেব সময়মতো না আসতেন তা হলে সেই ডেঞ্জারাস মেয়েটা নিশ্চয়ই পুলিশকে খবর দিত!”
কালাচান মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, পুলিশ একবার ধরলে আর উপায় আছে?” দবির মিয়া শিউরে উঠে বলল, “এইরকম কুফা আমাদের জীবনে আর লাগে নাই!”
কালাচান মিহি গলায় বলল, “জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিন। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের দিন।”
মন্তাজ ওস্তাদ এতক্ষণ কোনো কথা না বলে গভীর মনোযোগ দিয়ে দুইজনের কথা শুনছিল, এইবারে সে মুখ খুলল, বলল, “আসলে বলা যায় আজকের দিনটা হচ্ছে আমাদের জীবনের সবচেয়ে সৌভাগ্যের দিন।”
কালাচান এবং দবির মিয়া একসাথে চমকে উঠল, মন্তাজ ওস্তাদ কী বলছে বুঝতে না পেরে দুজনেই অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। ওস্তাদ পড়ে-যাওয়া দাঁতের ফাঁক দিয়ে পিচকি করে থুতু ফেলে বলল, “বলা যায় আজকের দিনটা আমাদের সবচেয়ে আনন্দের দিন।”
কালাচান কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, “কী বলছেন মন্তাজ ওস্তাদ? আনন্দের দিন? একটা বাচ্চা ছেলে আর মেয়ের সামনে একটা বুড়ি এইভাবে পিটিয়ে আমাদের বেইজ্জতি করল আর সেইটা আমাদের আনন্দের দিন?”
মন্তাজ ওস্তাদ মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”
দবির মিয়া ঢোক গিলে বলল, “সহজ একটা অপারেশন করতে গিয়ে মাখিয়ে ফেললাম–বায়নার টাকা পর্যন্ত ফিরিয়ে দিতে হবে। সেইটা আনন্দের দিন?”
“হ্যাঁ।” মন্তাজ ওস্তাদ চোখ ছোট ছোট করে বলল, “হ্যাঁ–সেইটা আনন্দের দিন। সেইটা সৌভাগ্যের দিন।”
কালাচান বলল, “আপনি কী বলছেন আমি তো তার কিছুই বুঝতে পারছি না মন্তাজ ওস্তাদ।”
মন্তাজ ওস্তাদ আয়নায় শেষবার তার দাঁতের গর্তটা লক্ষ করে আয়নাটা সরিয়ে বলল, “তোরা যদি সব জিনিস বুঝতে পারতিস তা হলে তোরা একদিন আমার মতো ওস্তাদ হতে পারতি। কিন্তু তোরা বুঝিস না। তোরা সারাজীবন কালাচান আর দবির মিয়া থেকেয়াবি। চোখ থেকেও তোরা অন্ধ। কান থেকেও তোরা কালা।”
কালাচান এবং দবির মিয়া, তাদের মাথা নেড়ে উৎসুক হয়ে মন্তাজ ওস্তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। মন্তাজ ওস্তাদ দুই পাটি দাঁত বের করে দুইজনকে দেখিয়ে বলল, “আমার কোন দাঁতটা পড়েছে?”
কালাচান কিছু না বুঝে বলল, “উপরের পাটির মাঝখানের দাঁতটা।”
“ভেরি গুড। এখন বল বুড়ি ঘুসি মেরেছে কোনখানে?”
কালাচান এবং দবির মিয়া দুজনেই মাথা চুলকাল। দবির মিয়া বলল, “তা তো খেয়াল নাই।”
“সে আমার কোন দিকে ছিল?”
“ডানদিকে।”
“ডানদিক থেকে একজন থুরথুরে বুড়ি একটা ঘুসি মারল আর সামনের একটা দাঁত পড়ে গেল–ব্যাপারটা কী?”
কালাচান আর দবির মিয়া একজন আরেকজনের দিকে তাকায়, কিছু বলতে পারে না। মন্তাজ ওস্তাদ এবারে কালাচানের দিকে তাকিয়ে বলল, “এইবারে কালাচান তুই বল। বুড়ি তোর কোনখানে ঘুসি মেরেছে?”
“ইয়ে মনে হয়–পেটে।”
“আর তুই ব্যথা পেয়েছিস কোনখানে?”
কালাচান কপালে হাত দিয়ে বলল, “মাথায়।
“ভেরি গুড।” মন্তাজ ওস্তাদ এবারে দবির মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “এইবারে দবির মিয়া তুই বল। তোর নাকের এই অবস্থা কেন?”
দবির মিয়া ইতস্তত করে বলল, “পড়ে গিয়েছিলাম।”
“কেমন করে পড়লি?”
“ইয়ে–তা তো জানি না। কোথায় জানি পা বেঁধে পড়ে গেলাম।”
“তার অর্থ খালি ময়দানে তুই পা বেঁধে পড়ে গেলি।” মন্তাজ ওস্তাদ তার দাঁতের ফাঁক দিয়ে আবার পিচিক করে থুতু ফেলে বলল, “এখন আমাকে শেষ প্রশ্নটার উত্তর দে। ভেবেচিন্তে উত্তর দিবি–বেকুবের মতো উত্তর দিবি না।”
“জে ওস্তাদ। বলেন–”
“থুরথুরে একটা বুড়ি–যেই বুড়ি ঠিক করে হাঁটতে পারে না, থাবা দিয়ে একটা মশা পর্যন্ত মারতে পারে না, সেই বুড়ি ঘুসি মেরে আমার একটা দাঁত ফেলে দিল সেইটা কেমন করে সম্ভব?”
কালাচান বলল, “সেইটা তো আমারও প্রশ্ন। কী তেলেসমাতি কাণ্ড! কী আচানক ব্যাপার!”
মন্তাজ ওস্তাদ ধমক দিয়ে বলল, “আচানক ব্যাপার বলে শেষ? ব্যাপারটা কী বলবি না?”
দবির মিয়া মাথা চুলকে বলল, “কীভাবে বলব? নিজের চোখে দেখলাম অবিশ্বাস করি কেমন করে?”
মন্তাজ ওস্তাদ একটা রহস্যের ভান করে বলল, “নিজের চোখে দেখলেও অবিশ্বাস করতে হয়। এই চারটা অবিশ্বাসের জিনিস ঘটেছে তার কারণটা কী জানিস?”
“কী ওস্তাদ?”
“তার কারণ হচ্ছে সেই বাসায় আরও একজন ছিল!”
কালাচান আর দবির মিয়া একসাথে চিৎকার করে বলল, “আরও একজন ছিল?”
“হ্যাঁ।”
“কোথায়? আমরা তো দেখলাম না!”
“দেখলে না তার কারণ হচ্ছে তারে চোখে দেখা যায় না।”
দবির মিয়া বুকে হাত দিয়ে বলল, “ইয়া মাবুদ! কী বলেন আপনি ওস্তাদ?”
“আমি ভুল বলি না। আমি ঠিক কথা বলি।”
“একজন মানুষ–তারে চোখে দেখা যায় না–সেইটা কি ভূত? নাকি জিন?”
“সেটা আমি জানি না।” মন্তাজ ওস্তাদ গম্ভীর গলায় বলল, “কিন্তু আমি জানি সেই ছেলে আর মেয়েটা তারে চিনে। তাদের সাথে খাতিরও আছে। তারা মনে হয় দেখতেও পায়”
কালাচান জিজ্ঞেস করল, “দেখতে পায়?”
“হ্যাঁ। মনে নাই মাঝখানে হঠাৎ কে দরজা ধাক্কা দিল–”
“জে ওস্তাদ মনে আছে।”
“দরজা খুলে দেখা গেল কেউ নাই?”
“জে ওস্তাদ।”
“আসলে তখন সেই অদৃশ্য মানুষ এসেছিল। সে এসে ঢোকার পরেই সেই ছেমড়ির সাহস বেড়ে গেল! মনে আছে?