কথাটার কী মানে টুশি কিছুই বুঝতে পারল না, সে আবার বলল, “নানির কী একটা বাড়ি নিয়ে সমস্যা–”
এবারে চাচি কথা ঘোরানোর চেষ্টা করলেন, নানির দিকে তাকিয়ে বললেন, “মা, তোমার ব্লাডপ্রেশার বাড়ে নাই তো?”
নানি বললেন, “আর ব্লাডপ্রেশার! এই বয়সে মারপিট করতে হলে ব্লাডপ্রেশার ঠিক থাকে কেমন করে?”
টুশি বলল, “এদেরকে পুলিশে দিতে হবে না?”
চাচা আবার মাছের মতো খাবি খেলেন, বললেন, “পু-পুলিশ?”
“হ্যাঁ।”
“আমি ফোন করব?”
চাচা এবারে লাফ দিয়ে উঠে একেবারে হা হা করে উঠলেন, “না-না–তোমার করতে হবে না। তোমার করতে হবে না। আমি করব। আমি করব।”
“ঠিক করে বাঁধতে পারি নাই। যদি পালিয়ে যায়?”
“কী দিয়ে বেঁধেছ?”
“চাচির একটা শাড়ি দিয়ে।”
চাচি এবারে প্রথমবার তাঁর শাড়িটা দেখে আঁতকে উঠে কাঁদোকাঁদো গলায় বললেন, “আমার সবচেয়ে ফেবারিট সিল্কের শাড়ি!”
নানি মুখ ভেংচে বললেন, “রাখ তোর শাড়ি! বাঁধা যে হয়েছে এই বেশি!”
পুলিশের কথাটা আসার পর থেকে চাচা কেমন ছটফট করতে শুরু করলেন। চাচির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন, “এদেরকে পুলিশে দিতে হবে, তা ই না?”
চাচিকেও কেমন যেন বিভ্রান্ত দেখা গেল, বললেন, “মনে হয়।”
চাচা বললেন, “আমি নিয়ে যাই পুলিশের কাছে। কী বল?”
চাচি বললেন, “হা হা, সেটাই ভালো। পুলিশ বাসায় আসলে আবার হাজার ঝামেলা।”
টুশি ঠিক বুঝতে পারল না, তার কাছে মনে হল পুলিশকে ফোন করে বলে দেওয়াটাই সবচেয়ে সহজ, কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে চাচা-চাচি সেটা করতে চাচ্ছেন না। পুরো ব্যাপারটার মাঝেই কেমন জানি একটা রহস্যের গন্ধ, কিন্তু রহস্যটা কোথায় টুশি ঠিক বুঝতে পারল না।
পুরো সময়টুকু কাবিল কোহকাফী সোফায় গম্ভীর হয়ে বসে আলাপ শুনছিল এবং মাঝে মাঝে গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ছিল। শেষ পর্যন্ত যখন তিন মূর্তিকে লাইন ধরিয়ে বের করে নিয়ে যাওয়া হল কাবিল কোহকাফী বলল, “বুঝেছ সোনার চাঁদেরা–এইবারে তো ডাইনি বুড়ির হয়ে একটু কেচে দিয়েছি। পরের বার নিজের হয়ে হালুয়া করে ছেড়ে দেব।”
তার কথা টুশি এবং তপু ছাড়া আর কেউ শুনতে পেল না।
.
মাইক্রোবাসটা ছাড়তেই চাচা দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, “মন্তাজ, এরকম সহজ একটা কাজ করতে গিয়ে একদম গুবলেট করলে?”
মন্তাজ ওস্তাদ শীতল গলায় বলল, “আগে হাতের বাঁধনটা খুলেন। ব্লাড সার্কুলেশন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।”
দবির মিয়া বলল, “এইটুকু মেয়ের জোর কম না–এমন করে বেঁধেছে যে হাত কেটে বসে যাচ্ছে।”
দেখা গেল বাঁধনটা খোলা সহজ না, টুশি এমন করে গিঁট মেরেছে, যে ভোলার কোনো উপায়ই নেই। চাচির সবচেয়ে ফেবারিট সিল্কের শাড়ি জানার পরও চাচা। সেটা কেটে ওস্তাদ এবং তার দুই সাগরেদের হাতগুলো মুক্ত করলেন।
মন্তাজ ওস্তাদ তার হাতের কবজিতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “ইমতিয়াজ সাহেব, আমি আজ বারো বছর এই লাইনে, আমি কাঁচা কাজ করি না। কিন্তু আজকের ব্যাপার অন্যরকম–”
চাচা রেগে উঠে বললেন, “মন্তাজ, তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে বল, সত্ত্বর বছরের থুরথুরে বুড়ি তোমাদের মতো এইরকম তিনজন প্রফেশনাল মানুষকে পিটিয়ে ফ্ল্যাট করে দিয়েছে?”
কালাচান তার মিহি গলায় কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, ওস্তাদ বাধা দিয়ে বলল, “ইমতিয়াজ সাহেব, আপনি কী বিশ্বাস করতে চান আর কী চান না সেইটা আপনার ইচ্ছা। আমি বলছি আমি যেটা দেখেছি। নিজের চোখে দেখেছি”
“কী দেখেছ?”
ওস্তাদ দাঁতের পাটি বের করে তার ফোকলা দাঁত দেখিয়ে বলল, “একটা দাঁত নাই। গত বারো বছরে দাঁত দূরে থাকুক একটা নখ কেউ ধরতে পারে নাই।”
“তুমি এই সামান্য কাজটা করতে পার না?” চাচা রেগেমেগে বললেন, “আমি এত টাকা দিয়ে বায়না করলাম”
“আপনার বায়নার টাকা আমি ফিরিয়ে দেব।” ওস্তাদ গম্ভীর গলায় বলল, “আমি এই কেস নিতে পারব না।”
কালাচান এবং দবির মিয়া ওস্তাদের সাথে তাল মিলিয়ে মাথা নেড়ে বলল, “অসম্ভব।”
চাচা বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এ কী বিপদে পড়লাম? প্রথমে বুড়ি ছিল শুধু একগুঁয়ে। এখন বুড়ি হয়ে গেছে বক্সার মোহাম্মদ আলি! এখন কী দশা হবে?”
ওস্তাদ তার ফোকলা দাঁতটায় হাত বুলিয়ে গভীর দুঃখের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আপনাকে একটা উপদেশ দেই ইমতিয়াজ সাহেব?”
“কী উপদেশ?”
“এই বুড়ির বাড়িতে আপনি হাত দিবেন না। বুড়ি যেটা করতে চায় সেটা করতে দেন।”
চাচা চোখ কপালে তুলে বললেন, “সেটা করতে দেব?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“কারণ এই বুড়ি খুব ডেঞ্জারাস। তার সাথে তেড়িবেড়ি করলে সে আপনারেও ফিনিশ করে দেবে।”
চাচা কোনো কথা না বলে অবাক হয়ে ফোকলা দাঁতের ওস্তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
.
মন্তাজ ওস্তাদ বলল, “কালাচান দরজা বন্ধ কর।”
কালাচান দরজা বন্ধ করে ওস্তাদের কাছে ফিরে এল। ওস্তাদ তার নিজের এপার্টমেন্টে একটা চেয়ারে বসে আছে, হাতে একটা ছোট আয়না, সে এই আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখছে। তার উপরের পাটির একটি দাঁত উধাও হয়ে যাওয়ার পর চেহারার কী পরিমাণ পরিবর্তন হয়েছে সেটাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করছে।
দবির মিয়া তার কপালের ফোলা অংশে হাত বুলিয়ে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আজকে কী-একটা ঘটনা ঘটল! তিনজন কী-একটা মার খেলাম!”