“তুই কথা বলিস বুড়ো মানুষের মতো। তুই চিন্তা করিস বুড়ো মানুষের মতো। কয়দিন পরে তোর চেহারাও হয়ে যাবে বুড়ো মানুষের মতো–”
টুশি এবারে হি হি করে হেসে বলল, “কী মজা হবে তখন, তাই না?”
নানা একটু রেগে বললেন, “ঠাট্টা করবি না। সিরিয়াস একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছি তার মাঝে ফাজলেমি করবি না।”
“কখন আবার আমি ঠাট্টা করলাম?” টুশি ঘরের মাঝামাঝি রাখা বিশাল কালো সিন্দুকের কাছে গিয়ে বলল, “এখন এটা খোলো।”
নানা বিশাল লম্বা একটা চাবি বের করে বললেন, “একশ বছর যে-তালা খোলা হয় নাই সেটা কি এত সহজে খোলা যাবে? দেখা যাক চেষ্টা করে।”
“খুলতে না পারলে তালা ভেঙে ফেলব।”
নানা বিশাল তালাটা দেখিয়ে বললেন, “এটা ভাঙা কি সোজা কথা? বোমা মেরেও এই তালা ভাঙা যাবে না!”
টুশি কালো সিন্দুকটার উপরে কৌতূহল নিয়ে একবার হাত বুলিয়ে দেখে, শক্ত কাঠের সিন্দুক, কাঠের মাঝে বিচিত্র একধরনের নকশা, এরকম একটা সিন্দুক তৈরি করতে কত দিন লেগেছে কে জানে! টুশি নিশ্বাস আটকে রেখে বলল, “ভিতরে কী আছে নানা?”
“আমি কী করে বলল?”
“তুমি কখনও খুলে দেখনি?”
“নাহ্!”
“কেন? তোমার দেখার ইচ্ছা হয় নাই?”
“নাহ্! আমার বাবা যখন ছোট ছিল তখন আমার দাদা এই সিন্দুকটা শেষবার খুলে বন্ধ করে রেখেছে। বলা হয়েছে আর যেন খোলা না হয়। আর খোলাও হয় নাই।”
টুশি চোখ বড় বড় করে বলল, “খুললে কী হবে?”
“আগের যুগের মানুষের অনেক রকম কুসংস্কার থাকে তো সে রকম একটা কুসংস্কার আর কি! ভিতরে নাকি অভিশাপ দেয়া জিনিস আছে।”
“আচ্ছা নানা, আমরা যদি খুলে দেখি ভিতরে একটা নরকঙ্কাল তা হলে কী করব?”
নানা মাথা চুলকে বললেন, “পুলিশকে খবর দিতে হবে মনে হয়।”
“আর যদি দেখি কলসি কলসি সোনা?”
“তা হলেও মনে হয় পুলিশকে খবর দিতে হবে!”
টুশি উত্তেজনায় বড় বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। তাড়াতাড়ি খোলো।”
নানা তালায় বড় চাবিটা ঢুকিয়ে খোলার চেষ্টা করতে লাগলেন। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর যখন খুলতে না পেরে হাল ছেড়ে দিচ্ছিলেন তখন হঠাৎ ঘঠাং করে তালাটা খুলে গেল। টুশি উত্তেজনায় নিশ্বাস নিতে পারে না। নানা তালাটা খুলে সিন্দুকটার ডালা টেনে উপরে তোলেন, কাঁচ ক্যাচ করে একটা শব্দ হল এবং সিন্দুকের ভেতর থেকে একটা ভ্যাপসা গন্ধ বের হয়ে এল। ডালাটা পুরোপুরি খুলে টুশি আর নানা একসাথে ভিতরে উঁকি দেয় এবং একেবারে হতবাক হয়ে যায়। ভিতরে কিছু নেই।
টুশি অবাক হয়ে একবার সিন্দুকের ভিতরে আরেকবার তার নানার দিকে তাকাল, বলল, “ভিতরে দেখি কিছু নাই!”
নানা মাথা চুলকালেন, বললেন, “তা-ই তো দেখছি!”
“তোমার দাদা আমাদের এপ্রিল ফুল করেছে।”
“সেরকমই তো মনে হচ্ছে।”
টুশি আবার ভিতরে উঁকি দিয়ে বলল, “দাঁড়াও। একেবারে খালি নয়। ঐ দেখো, কী যেন একটা আছে!”
নানা আবার উঁকি দিলেন, সত্যিই এক কোনায় ছোট কী-একটা আছে, আলো পড়ে চকচক করছে। নানা উবু হয়ে ধরার চেষ্টা করে নাগাল পেলেন না–তখন টুশি ঝুঁকে পড়ে জিনিসটা তুলে আনল।
“কী এটা?”
টুশি জিনিসটার দিকে তাকিয়ে বলল, “একটা ছোট বোতল।”
“বোতল?” নানা হাত বাড়িয়ে বললেন, “দেখি।”
টুশি বোতলটা নানার হাতে দিল, নানা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে টুশির হাতে ফেরত দিয়ে বললেন, “আশ্চর্য! এত বড় একটা সিন্দুকে এইটুকুন একটা বোতল? এটাকে বোতল না বলে বলা উচিত শিশি।”
টুশি ভালো করে ছোট বোতলটা দেখল। বেশ ভারী, মনে হয় পাথরের তৈরি, কালচে রং–ভিতরে কিছু আছে কি না বোঝা যায় না। মুখটা খুব ভালো করে বন্ধ করা আছে। মনে হয় কেউ ঝালাই করে লাগিয়েছে। বোতলটা দেখতেও বেশ অদ্ভুত, পারফিউমের যেমন আজব ধরনের শিশি থাকে অনেকটা সেরকম। টুশি হাতে নিয়ে কয়েকবার ঝাঁকিয়ে বলল, “ভিতরে কী আছে নানা?”
নানা ততক্ষণে পুরো ব্যাপারটাতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। সিন্দুকের ডালাটা বন্ধ করতে করতে বললেন, “এইটুকুন বোতলে কী আর হাতি-ঘোড়া থাকবে?”
“খুলে দেখি?”
“দ্যাখ।”
টুশি তখন ছিপিটা খোলার চেষ্টা করল, কিন্তু খুব শক্ত করে লাগানো, খোলা খুব সহজ হল না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। নানা বললেন, “ইদরিসকে দিস, খুলে দেবে।”
টুশি বলল, “আমি যদি না পারি ইদরিস ভাইও পারবে না। ইদরিস ভাইয়ের গায়ে কোনো জোর আছে নাকি?”
“তা ঠিক।” নানা হেসে বললেন, “তা হলে জমিলার মা’কে দিস, ঠিক খুলে দেবে।”
নানা আবার সিন্দুকে তালাটা লাগিয়ে বললেন, “কী কাণ্ড! একশ বছরের একটা রসিকতা।”
টুশি চোখ বড় বড় করে বলল, “নানা, এমন কি হতে পারে যে এই সিন্দুকের ভিতরে একটা ভূত আটকে ছিল এখন সেটা বের হয়ে গেছে! আমরা ঘুমালেই কটাশ করে আমাদের ঘাড় মটকে দেবে?”
“ঘাড় মটকাতেই যদি পারে তা হলে ঘুমানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে কেন?” নানা বললেন, “জেগে থাকলেও ঘাড় মটকাতে পারবে।”
টুশি নিজের ঘাড়ে হাত বুলিয়ে বলল, “আসুক না আমার ঘাড় মটকাতে, আমি উলটো ভূতের ঘাড় মটকে ছেড়ে দেব না!”
নানা টুশির দিকে তাকিয়ে বললেন, “তা তুই পারবি।”
“আচ্ছা নানা ভূতটা তো ভালো ভূতও হতে পারে। খুব সুইট একটা ভূত। মায়া-মায়া চেহারা। হতে পারে না?”
“তুই যখন বলছিস হতেও তো পারে। আমি তো আর ভূতের এক্সপার্ট না। তুই হচ্ছিস ভূতের এক্সপার্ট।”