টুশি বলল, “নানি এখন আমাদেরকে রক্ষা করো।”
নানি এবারে গুটি গুটি তাদের দিকে এগুতে লাগলেন। টুশি টের পেল দবির মিয়া এবং কালাচান এবারে কেমন যেন নার্ভাস হয়ে গেছে। তারা একজন আরেকজনের দিকে তাকাল-দবির মিয়া ভয়ে ভয়ে বলল, “খবরদার, ভালো হবে না কিন্তু কালাচান তার মিহি গলায় বলল, “শেষ করে দিব আমরা–”
নানির এখন তার নতুন শক্তিতে পুরোপুরি বিশ্বাস–একটুও না ঘাবড়ে বললেন, “বলদের বাচ্চা বলদ, ছারপোকার ডিম, ইঁদুরের লেজ, তোদের চেহারা যেরকম খারাপ খাসলত সেরকম খারাপ, আজকে যদি আমি তোদের পিটিয়ে সিধে
করি, ঘুসি মেরে যদি ভুড়ি ফাঁসিয়ে না দিই, জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে যদি কুকুরকে না খাওয়াই”
নানি তাঁর শুকনো পাতলা দুর্বল শরীর নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে আসতে লাগলেন। তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে তিনি আগে কখনও কাউকে ঘুসি মারেন নি আজকে প্রথম দুটি ঘুসিতে যেভাবে ওস্তাদকে কাবু করেছেন তার বিশ্বাস এই দুজনকেও সেভাবে কাবু করতে পারবেন। টুশি চোখের কোনা দিয়ে দেখল কাবিল কোহকাফীও প্রস্তুত হয়ে আছে। ওস্তাদ শুকনো পাতলা মানুষ ছিল, সে ঘুসি মেরে কাবু করে দিয়েছে, কিন্তু এই দুজন প্রায় ছোটখাটো পাহাড়ের মতো, কাবিল ঘুসি মেরে কাবু করতে পারবে সে ব্যাপারে এতটা নিঃসন্দেহ নয়। তাই সে একটা চেয়ার হাতে ধরে রেখেছে, নানি ঘুসি মারার সাথে সাথে সে পিছন থেকে এটা দিয়ে মাথায় মারবে।
নানি মূর্তিমান যমের মতো এগিয়ে আসতে লাগলেন, টুশি বলল, “নানি বেশি কাছে আসার দরকার নাই। দূর থেকেই ঘুসি মারো–”
নানি একটু দূর থেকেই মারলেন–ঘুসিটা কালাচানের গায়ে লাগল কী না বোঝা গেল না কিন্তু সাথে সাথে বিকট আর্তনাদ করে ধড়াম করে সে নিচে পড়ে গেল। নানি দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললেন, “কত বড় সাহস, আমার সাথে লাগতে আসে!”
দবির মিয়ার বুকের ভেতর যেটুকু সাহস ছিল কালাচানের অবস্থা দেখে সেটুকুও উবে গেছে। সে টুশিকে ছেড়ে দিয়ে এবারে পালানোর চেষ্টা করে কিন্তু নানি এত সহজে তাদের ছেড়ে দেবার পাত্র নন, বললেন, “ধর–ধর বেটা বদমাইশকে”
ঘুসির মতো কথাতেও কাজ হল, দবির মিয়ার বিশাল দেহ কলাগাছের মতো পড়ে গেল, নানি দেখতে পেলেন না যে কাবিল তাকে পা বাধিয়ে ফেলে দিয়েছে।
তিনজনকেই ধরাশায়ী করে নানি হাত ঝাড়া দিয়ে কোমরে হাত রেখে অনেকটা বিজয়ী জেনারেলের মতো বললেন, “কেমন শিক্ষা হয়েছে এই ইন্দুরের বাচ্চাগুলোর?”
তপু বলল, “ভা-ভা-ভা “।
টুশি তপুর অসমাপ্ত কথা শেষ করে বলল, “ভালো শিক্ষা হয়েছে!”
নানি জিজ্ঞেস করলেন, “আর কোনোদিন তেড়িবেড়ি করবে?”
টুশি মাথা নাড়ল, “না নানি। আর সাহস পাবে না।”
নানি বললেন, “আয় দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলি।”
বাসায় দড়ি খুঁজে পেল না তাই টুশি বুদ্ধি করে চাচির একটা শাড়ি বের করে সেটা দিয়ে তিনজনের হাত বেঁধে ফেলল। মানুষগুলো কোনো প্রতিবাদ করল না দুই কারণে, প্রথমত, নানি ক্যারাটের ভঙ্গিতে ঘুসি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, দ্বিতীয়ত, তপু ওস্তাদের পিস্তলটা হাতে দাঁড়িয়ে হুঙ্কার দিয়ে বলছিল, “একটু নড়লেই খু-খু খুন করে ফেলব।”
“খুন করে ফেলব” কথাটাই খুব ভয়ংকর সেটাকে যখন “খু-খু-খুন করে ফেলব” বলা হয় তখন সেটাকে আরও একশ গুণ বেশি ভয়ংকর শোনায়।
১১. ষড়যন্ত্র
বাসায় ঢুকে চাচা এবং চাচি যখন দেখলেন মন্তাজ ওস্তাদ এবং তার দুই সাগরেদকে পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা আছে, ওস্তাদের উপরের পাটির সামনের একটা দাঁত নেই, দবির মিয়ার কপালটা উঁচু হয়ে ফুলে আছে এবং কালাচানের নাকে রক্ত শুকিয়ে আছে তখন তাদের চোয়াল ঝুলে পড়ল। চাচা এবং চাচি দুজনেই কথা বলতে চেষ্টা করলেন কিন্তু কেউই কথা বলতে পারলেন না। চাচার মুখ বেশ কয়েকবার নড়ল এবং শেষ পর্যন্ত রিকশার টায়ার থেকে বাতাস ছেড়ে দেয়ার মতো একটা শব্দ বের হল।
তপু রিভলবারটা নাচিয়ে বলল, “আব্ব সব কয়টাকে ধরে ফেলেছি।”
তার কথায় তোতলামোর চিহ্ন নেই কিন্তু সেটা চাচা এবং চাচি খেয়ালও। করলেন না, চাচা জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন করে ধরেছিস?”
“নানি ঘুসি মেরে সবগুলোকে ফেলে দিয়েছে।”
তপুর উত্তর শুনে চাচি একটা চেয়ার ধরে নিজেকে সামলে নেন–চাচা সাবধানে একটা চেয়ারে বসলেন। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বললেন, “ঘুসি মেরে?”
“জি।”
“তোর নানি?”
“জি।”
চাচা মেঝেতে বসে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “সত্যি?”
মন্তাজ ওস্তাদ এবং অন্য দুইজন পুতুলের মতো মাথা নেড়ে ব্যাপারটা স্বীকার করল। চাচা আবার রিকশার চাকা থেকে বাতাস বের করে দেয়ার মতো শব্দ করলেন। চাচি ভয়ে ভয়ে নানির দিকে তাকালেন, নানি হাত ঝেড়ে বললেন, “এইবার ছেড়ে দিয়েছি। পরের বার কিন্তু ছাড়ব না–একেবারে খুন করে ফেলব।”
টুশি বলল, “চাচা, এরা কী-একটা কাগজে সাইন করাতে এসেছিল–”
কাগজে সাইন করানোর কথা শুনে চাচা হঠাৎ কথা ঘুরানোর জন্যে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, “ও, আচ্ছা ঠিক আছে-”তোমরা কেউ কোনো ব্যথা পাও নাই তো?”
টুশি বলল, “না, চাচা। কিন্তু এই যে কাগজটা দেখেন”।
চাচা ছোঁ মেরে কাগজটা নিয়ে দেখার ভান করে তাড়াতাড়ি ভাঁজ করে পকেটে রেখে বললেন, “ইয়ে তার মানে মনে হয় ঠিকই কিন্তু যা বলছিলাম”।