কালাচান তার মিহি গলায় ফিসফিস করে বলল, “এটা কে হতে পারে। ওস্তাদ?”
মন্তাজ ওস্তাদের মুখে চিন্তার একটা ছায়া পড়ল, সে মাথা চুলকে বলল, “এখন তো কারও আসার কথা না।”
মনে হয় ওস্তাদের কথাটা ভুল প্রমাণ করার জন্যেই আবার দুইবার কলিংবেল বেজে উঠল। ওস্তাদ ফিসফিস করে নিচু গলায় বলল, “দবির তুই এই মেয়েটারে নিয়ে দরজার কাছে যা। মেয়েটা দরজা খুলে যে আসছে তারে বিদায় করবে।” তারপর টুশির দিকে তাকিয়ে রিভলবারটা নাচিয়ে বলল, “ছেমড়ি যদি তুমি কোনো তেড়িবেড়ি কর তা হলে কিন্তু এই ছেমড়ার জান শেষ। একেবারে মগজের মাঝে, গুল্লি। ঠিক আছে?”
টুশি মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে।”
দরজায় আবার দুইবার কলিংবেলের শব্দ হল, যে-ই এসে থাকুক মানুষটার শরীরে ধৈর্য নামক পদার্থটি একেবারে নেই।
মন্তাজ ওস্তাদ রিভলবারটা নাচিয়ে বলল, “যা কালাচান। নিয়ে যা।”
টুশিকে প্রায় গলাধাক্কা দিয়ে দরজার কাছে নিয়ে গেল দবির মিয়া। দরজার কাছে নিয়ে তাকে ছেড়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, “দরজা খোলো।”
টুশি দরজা খুলল এবং সাথে সাথে তার মুখ একশ ওয়াট বাল্বের মতো জ্বলে উঠল। দরজার সামনে কাবিল কোহকাফী দাঁড়িয়ে আছে। আজকে তার চেহারা আরও খোলতাই হয়েছে। চোখে কালো চশমা আর গলা থেকে একটা লাল গামছা ঝুলছে। টুশিকে দেখে মুখ খিঁচিয়ে বলল, “এতক্ষণ লাগে দরজা খুলতে?”
টুশি কোনো কথা না বলে কাবিল কোহকাফীর চোখের দিকে তাকিয়ে খুব সূক্ষ্মভাবে তাকে একটা সংকেত দেবার চেষ্টা করল, কিন্তু কাবিলের ভিতর কোনো সূক্ষ্ম ব্যাপার নেই, সে কিছুই বুঝতে পারল না। দবির মিয়া ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “কে? বিদায় করে দাও তাড়াতাড়ি।”
টুশি বেশ কষ্ট করে মুখে একটা আশাভঙ্গের ছাপ ফুটিয়ে দরজা খুলে বলল, “কেউ না।”
“কেউ না?” দবির মিয়া নিজেও এবারে এগিয়ে আসে–সে কাবিল কোহকাফীকে দেখতে পায় না কিন্তু কাবিল কোহকাফী তাকে দেখতে পেয়ে আঁতকে উঠে বলল, “ইয়া মাবুদ! এই কালা বিরিশ কোথা থেকে এসেছে?”
টুশি কোনো কথা বলল না, দরজাটা আরেকটু খুলে দিল, কাবিল কোহকাফী সাবধানে ভিতরে ঢুকে যায়। দবির মিয়া দরজা দিয়ে মাথা বের করে দুই দিকে দেখে পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হয়ে নিল আসলেই কেউ নেই। তখন সে বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে দরজাটা বন্ধ করে টুশির ঘাড়ে একটা ধাক্কা দিয়ে ভিতরের দিকে যেতে শুরু করে। কাবিল চিৎকার করে বলল, “এই ব্যাটা কালা বিরিশ, তুই এই মেয়েটার ঘাড়ে ধাক্কা দিচ্ছিস যে?”
তার কথা টুশি আর তপু ছাড়া কেউ শুনতে পেল না। টুশি কিছু বলল না, কিন্তু তপু সবকিছু ভুলে আনন্দে চিৎকার করে উঠল–”কা-কাকা-কা–”
ভাগ্যিস সে কথা শেষ করতে পারল না। ওস্তাদ তপুর দিকে তাকিয়ে বলল,– “কী হল, তুমি কাকের মতো কা কা করছ কেন?”
কাবিল বসার ঘরে এসে ঢুকে চারিদিকে তাকিয়ে বলল, “কী হচ্ছে এখানে? এই বদমাইশগুলো কী করতে চায়?”
তপু আবার বলার চেষ্টা করল, “কা-কাকা-কা” কিন্তু এবারেও বেশিদূর এগুতে পারল না। টুশি অনুমান করল শব্দটা নিশ্চয়ই কাবিল হবে।
মন্তাজ ওস্তাদ কলমটা এবারে নানির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “খালা কেউ আসে নাই। আমরা অনেক হিসাব করে এসেছি। এখন এখানে কেউ আসবে না। কাজেই দেরি না করে এইখানে একটা সাইন করেন খালা।”
ব্যাপারটি কী হচ্ছে বোঝার জন্যে কাবিল ওস্তাদের খুব কাছাকাছি এগিয়ে গেল। তার চোখেমুখে চরম বিরক্তি, ওস্তাদকে একটা মজা বোঝানোর জন্যে সে হাত দুটি মুষ্টিবদ্ধ করে প্রস্তুত হতে শুরু করে।
নানি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাইন করতে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখন টুশি বলল, “নানি।”
নানি অবাক হয়ে টুশির দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হল বোনডি?”
“তোমার যদি ইচ্ছা না করে তা হলে তুমি সাইন কোরো না।”
মন্তাজ ওস্তাদ হুঙ্কার দিয়ে বলল, “কী বলিস পুঁচকে মেয়ে? তোর সাহস তো দেখি কম না!”
টুশি ওস্তাদকে একেবারে কোনো পাত্তা না দিয়ে বলল, “নানি, তুমি এক কাজ করো–ইঁদুরের মতো দেখতে লোকটার পেটে একটা ঘুসি মারো।”
নানি চোখ কপালে তুলে বলল, “ঘুসি মারব?”
“হ্যাঁ নানি।”
নানি আবার জিজ্ঞেস করলেন, “ঘুসি?”
“হ্যাঁ–দেখবে ব্যাটার কী অবস্থা হয়।”
“সত্যি বলছিস বোনডি?”
“সত্যি বলছি।”
ঘুসি কীভাবে মারতে হয় নানির জানা নেই। তবুও তিনি হাতটা ঘুরিয়ে অত্যন্ত হাস্যকর একটা ভঙ্গিতে ওস্তাদের পেটে একটা ঘুসি মারলেন। কিন্তু সেই ঘুসির ফল হল ভয়ানক–ওস্তাদ একেবারে ছিটকে প্রায় উড়ে গিয়ে ঘরের অন্যপাশে আছাড় খেয়ে পড়ল, দেয়ালে মাথা ঠুকে তার চোখ একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল। আসল ব্যাপারটি দেখল শুধু টুশি আর তপু। নানির ঘুসির সাথে তাল মিলিয়ে কাবিল তার সমস্ত শক্তি দিয়ে মন্তাজ ওস্তাদের পেটে একটা ঘুসি মেরেছে!
কালাচান এবং দবির মিয়া একেবারে হতবাক হয়ে নানির দিকে তাকিয়ে রইল। তাদের দুইজন থেকেও বেশি অবাক হল ওস্তাদ এবং ওস্তাদ থেকেও বেশি অবাক হলেন নানি। তিনি অবাক হয়ে যেই হাত দিয়ে ঘুসি মেরেছেন সেই হাতের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
টুশি বলল, “নানি ছেড়ে দিও না। গিয়ে আর কয়টা কিল-ঘুসি মারো।”
নানি উৎসাহ পেয়ে সোফা থেকে নেমে গুটি গুটি হেঁটে গিয়ে মন্তাজ ওস্তাদের মুখে আরেকটা ঘুসি মারলেন, কাবিল সেই ঘুসিতে সাহায্য করল এবং ওস্তাদ বিকট আর্তনাদ করে একেবার ধরাশায়ী হয়ে গেল। টুশি দেখল মানুষটারে উপরের পাটির একটা দাঁত খুলে এসেছে এবং থুঃ করতেই দাঁতটা বের হয়ে এল।