টুশি একটু কেশে বলল, “নানি।”
নানি তেরিয়া হয়ে বললেন, “কী হয়েছে?”
“এদের কাছে পিস্তল।”
তপু বলল, “পি-পি-পি-পি–” সে কথা শেষ করতে পারল না, টুশি ধরে নিল পিস্তল বলতে গিয়ে ভয়ের চোটে কথা আটকে গেছে।
নানি জিজ্ঞেস করলেন, “পিস্তলটা আবার কী?”
“বন্দুকের মতো। সাইজে ছোট।”
তপু বলল, “ব-ব-ব-ব-ব” টুশি ধরে নিল বন্দুক বলতে গিয়ে কথা শেষ করতে পারছে না।
মন্তাজ ওস্তাদ এইবারে পিস্তলটা হাতবদল করে বলল, “খালার চোখ মনে হয়। ভালো না। ছানি পড়েছে। ভালো দেখতে পান না। এই যে এইটারে পিস্তল বলে, ট্রিগার টানলে গুলি বের হয়।”
“খাটাশের বাচ্চা খাটাশ, তুই আমারে কী পেয়েছিস? আমি কি তোর পিস্তলরে ভয় পাই?” নানি আবার মুখে তুবড়ি ছোটালেন, “খ্যাংড়া কাঠির ঝাড় দিয়ে তোর ভূত আমি নামাব। খড়ম দিয়ে পিটিয়ে সিধা করব”।
মন্তাজ ওস্তাদের কালো মুখে অপমানের বেগুনি ছোপ ছোপ রং দেখা গেল। গণ্ডারের মতো চেহারার কালাচান তার মিহি রবীন্দ্রসংগীতের গলায় বলল, “ওস্তাদ এই মহিলার মুখ তো দেখি খুব খারাপ। একটা গুলি দিব নাকি চাঁদির মাঝে? মুখ বন্ধ করে দিব?”
মন্তাজ ওস্তাদ কালাচানকে ধমক দিয়ে বলল, “চুপ কর বেকুব। মুখ বন্ধ করে দিলে কাজ শেষ করব কেমন করে?” তারপর পিস্তলটা নাচাতে নাচাতে নানির একেবারে কাছে গিয়ে বলল, “খালা আপনার তো দুই পাই কবরে পিস্তলরে তো আপনার ভয় পাওয়ার কথা না। তবে–” ওস্তাদ খুব অর্থপূর্ণভাবে হেসে বলল, “আপনার দুই নাতি-নাতনির কিন্তু একেবারে কাঁচা বয়স। তারা মনে হয় পিস্তলরে ভয় পায়!”
“তুই কী বলতে চাস ছাগলের বাচ্চা ছাগল?”
“এই যে দেখছেন আমার দুই অ্যাসিস্টেন্ট তাদের নাম হচ্ছে কালাচান আর দবির মিয়া। এরা খালি হাতে টিপি দিয়ে ছোট বাচ্চার কচি মাথা মুরগির ডিমের মতো পটাশ করে ফাটিয়ে দিতে পারে। আমি অনেক চিন্তাভাবনা করে তাদেরকে নিয়ে এসেছি। কেন এনেছি জানেন?”
“কেন?”
“এই দবির মিয়া ধরবে মেয়েটারে, কালাচান ধরবে ছেলেটারে–আর আপনি যদি আমার কথা না শোনেন তা হলে দবির মিয়া পুটুস করে মেয়েটার মাথাটা টিপে গুঁড়ো করে দেবে, নাক দিয়ে তখন তার ঘিলু বের হয়ে আসবে। তাই না রে দবির?”
দবির মিয়া বাধ্য ছেলের মতো বলল, “জি ওস্তাদ।”
নানি কয়েকবার কিছু-একটা কথা বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু এবারে তার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হল না।
মন্তাজ ওস্তাদ তার দুই সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বলল, “এই দবির আর কালাচান–সময় নষ্ট করে লাভ নাই। দুইজন দুইটারে ধর। আগেই পুটুস করে মাথাটা গুঁড়া করিস না”
কালাচান তার মিহি গলায় বলল, “জি ওস্তাদ।” তারপর দুই পা হেঁটে তপুর ঘাড় ধরে তাকে প্রায় শূন্যে ঝুলিয়ে সরিয়ে নিয়ে গেল। তপু বলল, “আ-আ-আ আ-_”
সে কী বলার চেষ্টা করছে টুশি এইবারে আন্দাজ করতে পারল না। দবির মিয়া। টুশির দিকে এগিয়ে এসে তার ঘাড় ধরে একপাশে টেনে নেয়। মানুষটার কালো লোমশ হাত দেখে টুশির কেমন জানি শরীর শিরশির করতে থাকে।
মন্তাজ ওস্তাদ এবারে গলার স্বর নরম করে নানিকে বলল, “খালা। আমি দশ পর্যন্ত গুনব। তার মাঝে আপনি এই কাগজটা সাইন করবেন। যদি না করেন তা হলে প্রথমে পুটুস করে মেয়েটার তার পরে ছেলেটার মাথাটা টিকটিকির ডিমের মতো গুঁড়ো করে দেয়া হবে। বুঝেছেন?”
নানি মুখ হাঁ করে ওস্তাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর মুখ নড়ছে, দেখে
মন্তাজ ওস্তাদ হাতের পিস্তলটা নাচিয়ে বলল, “খালা আমাদের হাতে সাময় নাই। আমি দশ পর্যন্ত গুনব, তার মাঝে আপনার কাগজে সাইন করতে হবে। যদি না করেন, তা হলে–” কথা শেষ না করে ওস্তাদ হাত দিয়ে একজনের মাথা পিষে ফেলার ভঙ্গি করল।
তপু এবারে ভয় পেয়ে ফাসাস করে কাঁদতে শুরু করে। কালাচান মিহি গলায় বলল, “কাঁদছ কেন খোকা? মাথার হাড্ডি গুঁড়া করলে কিছু টের পাওয়া যায় না, তার আগেই শেষ!”
মন্তাজ ওস্তাদ গুনল, “এক।”
লাল মিয়া টুশির মাথায় হাত বুলিয়ে ঠিক কোন জায়গায় ধরে চাপ দেবে সেই জায়গাটা একবার দেখে নিল। হাতটা যে শুধু কালো আর লোমশ তা-ই নয় হাতের মাঝে সিগারেটের বোটকা গন্ধ।
মন্তাজ ওস্তাদ গুনল, “দুই।”
তপু কাঁদতে কাঁদতে বলল, “বাবা-বা-বা-বা–” শব্দটা কী হতে পারে টুশি চিন্তা করে বের করতে পারল না।
মন্তাজ ওস্তাদ বলল, “তিন।”
টুশির গলা শুকিয়ে যায়। এরা কারা কে জানে, কিন্তু মনে হচ্ছে একেবারে দয়ামায়াহীন দানব। সত্যি সত্যি যদি তার মাথা গুঁড়ো করে দেয়? মানুষটার হাত থেকে কি ছুটে যাবার চেষ্টা করবে? টুশি বুঝতে পারল তার কোনো উপায় নেই। মানুষটা একেবারে লোহার মতো শক্ত হাতে তার গলা এবং ঘাড় ধরে রেখেছে। নড়ার কোনো উপায়ই নেই।
মন্তাজ ওস্তাদ গুনল, “চার।”
নানি এবারে হাত বাড়িয়ে বললেন, “দে কাগজ হারামজাদা।”
মন্তাজ ওস্তাদ একগাল হেসে বলল, “খালা, আপনার মুখটা খুব খারাপ। কোনোদিন এর জন্যে আপনি কিন্তু বিপদে পড়বেন।” ওস্তাদ কাগজটা নানির হাতে দিয়ে বলল, “নেন খালা।”
“কলম কই?”
মন্তাজ ওস্তাদ তার পকেট থেকে কলমটা বের করে নানির হাতে দিচ্ছিল, ঠিক তখন দরজায় কলিংবেল বেজে উঠল। সাথে সাথে ঘরে সবাই একেবারে পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল। শুধু নানি খিক খিক করে মাঢ়ি বের করে হেসে বললেন, “এই তো লোকজন এসে গেছে, এখন বোঝো মজা!”