নানি ছোট বাচ্চাদের মতো দুই পা সোফায় তুলে গুটিসুটি মেরে বসেছিলেন। টুশি এবং তপু যতক্ষণ স্কুলে থাকে তার সময়টা কাটতে চায় না, বাচ্চা দুটো চলে এলে আর কোনো সমস্যা থাকে না। তার কাছ থেকে গল্প শোনার জন্যে পাগল হয়ে থাকে, তাদের সাথে গল্প করে সময়টা বেশ কেটে যায়। আজকেও তা-ই হচ্ছে, টুশি একটা বাটিতে খানিকটা সরষের তেল এনে নানির পায়ে ডলে ডলে মাখিয়ে দিচ্ছে, তপু মহা উৎসাহে হামানদিস্তায় পান-সুপুরি ঘেঁচে দিচ্ছে। নানির দাঁত নেই বলে একেবারে মিহি হতে হবে সেজন্যে সে একটু পরে পরে আঙুল দিয়ে পরীক্ষা করে দেখছে।
নানি তাঁর ছেলেবেলার গল্প করছেন, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে তার কী অবস্থা তার একটা ভয়ংকর বর্ণনা দিচ্ছেন, কিন্তু সেই ভয়ংকর অবস্থার গল্প শুনে দুজনেই হি হি করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। নানি কপট রাগে চোখ বড় বড় করে বলছেন, “এইটা হাসির কথা হল? আমি মরি দুঃখে আর তোরা সেই গল্প শুনে হাসিস”
এরকম সময়ে দরজায় কলিংবেলের শব্দ হল। থেমে থেমে দুইবার। টুশি এবং তপু একজন আরেকজনের দিকে তাকায়–কাবিল কোহকাফী কি এসেছে? সে ঢাকা শহরে ঘুরে ঘুরে বিচিত্র সব কর্মকাণ্ড করে বেড়াচ্ছে, তার বর্ণনা খবরের কাগজে উঠে আসছে–কখন কী বিপদ হবে কে জানে! টুশি উঠে দরজা খুলতে গেল। কিন্তু দরজা খোলার আগেই সে দেখতে পেল, বাইরে থেকে চাবি দিয়ে দরজা খুলে। ভিতরে তিনজন মানুষ ঢুকে গেছে।
তিনজন মানুষ দেখতে তিন রকম। একজন ছোট এবং শুকনো, চেহারার মাঝে একটা নেংটি ইঁদুরের ভাব। মুখটা ইঁদুরের মতো ছুঁচালো, চোখ দুটো কুতকুতে। তার পিছনে দুইজন মানুষের আকার বিশাল। একজনের মুখটা গোল, গায়ের রং ফরসা, সারা শরীরে মাংস, টাইট একটা টিশার্টের নিচে সেগুলো কিলবিল কিলবিল করছে, মানুষটাকে দেখলেই গণ্ডারের কথা মনে পড়ে। অন্য মানুষটির মাথাটা সরাসরি শরীরের উপর বসিয়ে দেয়া হয়েছে–কোনো গলা নেই। হাত দুটি লম্বা। এবং কেমন জানি সামনের দিকে ঝুঁকে আছে। গায়ের রং কুচকুচে কালো–সব মিলিয়ে একটা গরিলা-গরিলা ভাব। টুশি কয়েক সেকেন্ড অবাক হয়ে হাঁ করে এই বিচিত্র তিন মূর্তির দিকে তাকিয়ে রইল। সে একেবারে একশত ভাগ নিশ্চিত ছিল যে এরা ভুল করে এখানে চলে এসেছে, তার পরেও জিজ্ঞেস করল, “আপনারা। ভিতরে কেমন করে ঢুকেছেন? কাকে চান?”
ইঁদুরের মতো মানুষটা জিজ্ঞেস করল, “এইটা ইমতিয়াজ সাহেবের বাসা না?” মানুষটার গলা ফাটা বাঁশের মতো কর্কশ।
টুশি মাথা নেড়ে বলল, “জি। কিন্তু চাচা বাসায় নাই।”
ইঁদুরের মতো মানুষটা কর্কশ গলায় বলল, “তাতে কোনো অসুবিধা নাই। আমাদের দরকার তার শাশুড়ির সাথে!” এই বলে টুশিকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তিনজন ভিতরের দিকে রওনা দিল। টুশি এত অবাক হল যে ভয় পাওয়ারও সময় পেল না, গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনারা কে? এখানে কী চান?”
ইঁদুরের মতো মানুষটা টুশিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে বলল, “কালাচান দরজাটা বন্ধ কর। দবির মিয়া বুড়িরে খুঁজে বের কর।”
টুশি দেখল কুচকুচে কালো গরিলার মতো মানুষটার নাম দবির মিয়া, সে ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল। ফরসা এবং গণ্ডারের মতো মানুষটার নাম নিশ্চয়ই কালাচান, সে দরজা বন্ধ করে বলল, “জে মন্তাজ ওস্তাদ।” তার গলার স্বর মিহি মনে হয় পয়লা বৈশাখে পাঞ্জাবি পরে রমনার বটমূলে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে যায়।
টুশি এবার এত রেগে গেল যে অবাক হবার সময় পেল না, চিৎকার করে বলল, “আপনারা কেন এখানে এসেছেন? কেমন করে বাসার ভিতরে ঢুকেছেন? এক্ষুনি বাইরে যান–”
তখন টুশি আবিষ্কার করল, ইঁদুরের মতো মানুষটি যাকে কালাচান মন্তাজ ওস্তাদ বলে ডাকছে, তার হাতের ব্যাগ খুলে সেখান থেকে একটা বেঁটে রিভলবার বের করছে। টুশি তখন প্রথমবার বুঝতে পারল, এখানে খুব বড় গোলমাল আছে। এবং সে এই প্রথমবার ভয় পেল।
ওস্তাদ রিভলবারটা পরীক্ষা করে হাতে নিয়ে বলল, “এই মেয়ে, তুমি যদি আর একটা বাজে কথা বলো তা হলে গুলি করে তোমার খুলি ফুটো করে দেব। বুঝেছ?”
টুশি মাথা নাড়ল, ওস্তাদকে জানাল যে সে বুঝেছে। এরকম সময় বাইরের ঘর থেকে খুব ভারী এবং মোটা গলায় দবির মিয়া বলল,”ওস্তাদ, বুড়িরে পাইছি।”
ওস্তাদ তখন টুশিকে বাইরের ঘরের দিকে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে পিছনে পিছনে হেঁটে ঘরে ঢুকল। তপু এবং নানি অবাক হয়ে এই বিচিত্র দলটার দিকে তাকাল। নানি অবাক হয়ে বললেন, “কী গো বোনডি! এরা কারা?”
টুশি চিঁ চিঁ করে বলল, “আমি চিনি না নানি।”
“কার কাছে আসছে?”
“আপনার কাছে।”
“আমার কাছে?” নানি অবাক হয়ে ভুরু কুঁচকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলেন, জিজ্ঞেস করলেন, “কে বাবা? বাড়ি থেকে আসছ নাকি? তুমি জলিলের ভাই না?”
ইঁদুরের মতো মানুষটি, যে নিশ্চয়ই এই দলের নেতা এবং যাকে অন্য দুইজন মন্তাজ ওস্তাদ বলে ডাকছে এবারে নানির কাছে এগিয়ে বলল, “না খালা, আমি জলিলের ভাই না।”
“তা হলে তুমি কে?”
“আপনি আমারে চিনবেন না। আমরা আপনার কাছে বিশেষ কাজে এসেছি।”
“কী কাজ?”
“খিলগাঁয়ে আপনার একটা বাড়ি আছে না–”
নানি লোকটাকে কথা শেষ করতে দিলেন না, হঠাৎ করে চিলের মতো তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “ও আমার নেউলের বাচ্চা নেউল, খাটাশের বাচ্চা খাটাশ–আমার সাথে রং-তামাশা করতে আসছ–ঝাড় দিয়ে পিটিয়ে তোমার পিঠের ছাল যদি আমি না তুলি”