কাবিল কিন্তু পুরোপুরি বিশ্বাস করল না, কাছে এসে নানিকে দেখে পিছিয়ে গেল, বলল, “সব্বোনাশ! দেখে ভয় লাগে।”
টুশি চাপা গলায় বলল, “ভয় লাগার কী আছে? এত সুইট আমাদের নানি।”
“আমি যখন বাগদাদে ছিলাম, শাহজাদি দুনিয়ার সাথে এইরকম একজন ডাইনি বুড়ি ছিল। আমাকে জাদু করে দিল। একেবারে হাত-পা নাড়াতে পারি না
হাত-পা নাড়াতে না পারার কারণে তার কী অবস্থা হয়েছিল সেটা কাবিল তাদের অভিনয় করে দেখাল।
কাবিল আবার কাছে এসে নানিকে দেখে আবার লাফিয়ে পিছনে সরে গেল, বলল, “বাবারে বাবা! আমি এই ঘরে এই বুড়ির সাথে ঘুমাতে পারব না!”
তপু ফিসফিস করে বলল, “কো-কো-কোথায় ঘুমাবে তা হলে?”
“বাইরের ঘরে। গদিওয়ালা চেয়ারে।” কাবিল কোহকাফী মাথা নাড়তে নাড়তে বের হয়ে গেল। একটু পরেই তারা তার নাকডাকার শব্দ শুনতে পেল, মনে। হল সারা বাড়ি বুঝি থরথর করে কাঁপছে।
ভাগ্যিস কেউ তার নাক ডাকার শব্দ শুনতে পায় না–তা হলে কী যে সর্বনাশ হত! টুশি অবশ্যি খুব দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘুমাল–চাচা প্রতিদিন সকালে উঠে সোফায় বসে খানিকক্ষণ টেলিভিশন দেখেন। কাল সকালে যখন সোফায় বসতে গিয়ে কাবিল কোহকাফীর ভুড়িতে বসে যাবেন তখন কী যে একটা কেলেঙ্কারি হবে সেটা নিয়ে তার ঘুম হারাম হয়ে গেল। সকালে তার নিশ্চয়ই ঘুম ভাঙবে চেঁচামেচি এবং হইচই দিয়ে।
সত্যি সত্যি সকালে টুশি এবং তপুর ঘুম ভাঙল চেঁচামেচি এবং হইচই দিয়ে তবে কারণটা একটু ভিন্ন, চাচি চিৎকার করছেন চাচার উপরে, কারণ সকালে উঠে আবিষ্কার করেছেন যে বাইরের ঘরের দরজা খোলা। রাত্রিবেলা চাচা শেষবার দরজা খুলেছিলেন কাজেই তিনি নিশ্চয়ই দরজা খোলা রেখে ঘুমিয়েছেন। চাচা দুর্বল গলায় বললেন, “আমার স্পষ্ট মনে আছে দরজা বন্ধ করেছি।”
“ছাই মনে আছে!” চাচি মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “তোমার ঐ মোটা মাথায় ব্রেন কতটুকু যে এতকিছু মনে রাখতে পারবে?”
অন্য কোনোদিন হলে ঝগড়া অবশ্যি অনেকক্ষণ ধরে চলত–আজকে চাচা চাচি ইচ্ছে করেই সেটা বন্ধ করে ফেললেন। দিনটা খুব গুরুত্বপূর্ণঝগড়াঝাটি দিয়ে সেটা কেউই শুরু করতে চাচ্ছে না।
সকালবেলা নাস্তার টেবিলে সবাই তাড়াহুড়ো করে নাস্তা করছে। টুশি আর তপু যাবে স্কুলে, চাচা যাবেন অফিসে–অন্যদিন হলে চাচিও যেতেন, আজ নানির জন্যে চাচি বাসায় থাকছেন, টুশি আর তপু বাসায় ফেরত এলে কাজে যাবেন। সকালবেলা টুশির একেবারেই খেতে ইচ্ছে করে না, খুব কষ্ট করে রুটি টোস্ট জেলি মাখিয়ে খাচ্ছে, তখন হঠাৎ চাচা খবরের কাগজ দেখতে দেখতে বললেন, “ভেরি পিকিউলিয়ার!”
চাচি জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে?”
“খুব আশ্চর্য একটা খবর ছাপা হয়েছে।”
“কী খবর?”
“শোনো আমি পড়ছি।” চাচা পড়তে লাগলেন, “চান্দিছোলা জব্বর গ্রেফতার। ঢাকা বারোই অক্টোবর–ফার্মগেট এলাকা থেকে অপরাহু তিনটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে কুখ্যাত সন্ত্রাসী চান্দিছোলা জব্বরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। খবরে প্রকাশ চান্দিছোলা জব্বর ফার্মগেটের সামনে একটি গাড়ি থেকে কিছু অর্থ ছিনতাই করে পলায়ন করার সময় হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়ে এবং তাকে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিসহকারে নৃত্য করতে দেখা যায়। সে শূন্যে ঝুলে থাকে এবং হাত-পা নেড়ে নিজেকে আঘাত করে এবং বিকট গলায় আর্তনাদ করতে থাকে। চান্দিছোলা জব্বর এক পর্যায়ে তার রংচঙে টিশার্ট, জিন্সের প্যান্ট, টেনিস শু এবং মাথার বেসবল ক্যাপ খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শুধুমাত্র একটি অন্তর্বাস পরে অপ্রকৃতস্থের মতো ক্রন্দন করতে থাকে। ফার্মগেটের মোড় থেকে পুলিশ এসে তখন তাকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করে। তার খুলে ফেলা কাপড়, প্যান্ট এবং টিশার্ট উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি বলে তাকে শুধু অন্তর্বাস পরা অবস্থায় থানা-হাজতে প্রেরণ করা হয়। এই ব্যাপারে জোর পুলিশি তদন্ত চলছে।”
চাচা খবরটি পড়ে শেষ করার আগেই টুশি এবং তপু একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। চান্দিছোলা জব্বরের এই দুর্গতি কে করেছে এবং কাবিল কোহকাফী কোথা থেকে তার বিচিত্র পোশাক পেয়েছে বুঝতে তাদের বাকি থাকে না। কাল রাতে সে কী মজার ঘটনা বলতে চেয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত বলতে পারে নি সেটাও এখন পরিষ্কার হয়ে গেল।
খবরটি শুনে চাচি হাসি হাসি মুখে বললেন, “বড় বড় ক্রিমিনালরা যদি নিজেরাই নিজেদের কিল ঘুসি মেরে অ্যারেস্ট হয়ে যায় তা হলে তো মন্দ হয় না!”
চাচা বললেন, “কিন্তু আমি খবরের মাথা-মুণ্ডু কিছু বুঝতে পারলাম না! একজন মানুষ নিজে নিজে শূন্যে ঝুলে থাকে কেমন করে?”
চাচি হাত নেড়ে বললেন, “ওগুলো হচ্ছে খবরের কাগজের বিক্রি বাড়ানোর ফন্দি!”
টুশি আর তপু একজন আরেকজনের দিকে তাকাল–শুধু তারা দুজনেই জানে এটা খবরের কাগজের বিক্রি বাড়ানোর ফন্দি নয়। শুধু তা-ই নয়, শুধু তারাই জানে সত্যি সত্যি খবরে কাগজের বিক্রি বাড়ানোর খবরটি কী হতে পারে!
১০. তিন মূর্তি
চাচি ঘড়ি দেখে চিৎকার করে বললেন, “সর্বনাশ! তিনটা বেজে গেছে!”
টুশি বুঝতে পারল না তিনটা বেজে গেলে সর্বনাশ হবে কেন। তারা স্কুল থেকে আসার পর খাওয়াদাওয়া শেষ করতে করতে মাঝে মাঝেই তিনটা বেজে যায়। চাচি আজকে কেন জানি দেরি করলেন না, বাসা থেকে বের হওয়ার আগে সবসময় যেরকম ড্রেসিং-টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মুখে একটু কমপ্যাক্ট, চোখে আইলাইনারের ছোঁয়া এবং ঠোঁটে লিপস্টিক দেন, আজকে তাও করলেন না, চুলের মাঝে চিরুনি চালাতে চালাতে বাসা থেকে একরকম দৌড়ে বের হয়ে গেলেন। কী নিয়ে তাঁর এত তাড়াহুড়ো টুশি কিংবা তপু বুঝতে পারল না, তারা সেটা নিয়ে মাথাও ঘামাল না।