নানি বললেন, “দেখি নাই আবার!”
“দেখতে কেমন হয়?”
“এই লম্বা লম্বা দাড়ি। এইরকম ছোট। পায়ের মুড়া হয় উলটো দিকে।”
“তাদের মেজাজ কেমন হয়?”
“সব্বোনাশ! খুব রাগী হয়। চোখ দিয়ে একেবারে আগুন বের হয়।”
“নানি, এরকম কি হতে পারে যে তারা খুব ঠাণ্ডা মেজাজের হয়? খুব সুইট হয়? জোকারের মতন?”
নানি চোখ বড় বড় করে বললেন, “কী বলিস তুই? ঠাণ্ডা মেজাজ! কখনও না!”
“কেন নানি? তুমি আরব্যরজনী পড় নাই? জিনেরা এরকম বড় বড় কলসি ভরা সোনার মোহর নিয়ে আসত?”
নানি মাঢ়ি বের করে হেসে বললেন, “ঐগুলো তো গল্প-গল্পে কতকিছু হয়!”
টুশি বলল, “কিন্তু সত্যি সত্যি কি জিন থাকতে পারে না যেটা খুব ভালো?”
নানি একটু চিন্তার মাঝে পড়ে গেলেন, শনের মতো পাকা চুলে হাত দিয়ে বিলি কেটে বললেন, “সেটা মনে হয় থাকতে পারে।”
“সেই জিনকে আমরা যদি কিছু-একটা করতে বলি সেটা কি করবে?”
নানি হেসে বললেন, “তুই জিন পাবি কোথায়? ঢাকা শহরে কী আর জিন আছে? আর থাকলেই কি সেটা তোর কথা শুনবে?”
তপু জ্বলজ্বলে চোখে টুশির দিকে তাকাল, কাবিল কোহকাফীর কথা বলার জন্যে নিশ্চয়ই তপুর মুখ সুড়সুড় করছে। টুশি অবশ্যি তপুকে চিমটি কেটে থামাল। এখনও এটা বলার সময় হয় নাই এবং বললেও নানি বিশ্বাস করবেন না।
নানি মুখে ভয়ের একটা চিহ্ন ফুটিয়ে বললেন, “জিন বন্দি করার দোয়া আছে। অনেক কঠিন দোয়া–সেই দোয়া পড়ে জিন বন্দি করা যায়। তখন জিনকে যেটা বলা যায় জিন সেটা করে।”
তপু বলল, “জিনকে বন্দি করে কি বো-বোতলে ভরতি করা যায়?”
“বোতল? বোতলে কেন?”
“এই ইয়ে মা-মানে এমনি?”
নানি হি-হি করে হেসে বললেন, “জিন কি আমের আচার, নাকি ওষুধের ট্যাবলেট যে বোতলে আর শিশিতে ভরতে চাস!”
টুশি বলল, “আচ্ছা নানি মনে করো একটা জিনের সাথে আমার খুব খাতির হল। তা হলে কি সেই জিনটাকে আমি যেটাই বলি সেটাই করবে?”
নানি তাঁর পাকা শনের মতো চুলে হাত বুলিয়ে বললেন, “তা নিশ্চয়ই করবে!”
“আমি যদি বলি, আমার চোহরাটা সুন্দর করে দাও–তা হলে কি সুন্দর করে দেবে?”
নানি টুশির থুতনি ধরে আদর করে বললেন, “ওমা! কী বলিস তুই? তোর চেহারা তো এখনই কত সুন্দর!”
“ছাই সুন্দর। তুমি আগে বলো জিন কী সুন্দর করে দিতে পারবে?”
নানি গম্ভীর মুখে মাথা নাড়লেন, বললেন, “নিশ্চয়ই পারবে। জিনেরা সবকিছু পারে।”
তপু চোখ বড় বড় করে টুশিকে বলল, “আপু তু-তুমি কি কা-কাবিলকে তাই বলবে?”
নানি বললেন, “কাবিল? কাবিলটা কে?”
টুশি তাড়াতাড়ি বলল, “না-না, কেউ না।” নানি ব্যাপারটি নিয়ে বেশি মাথা ঘামালেন না দেখে টুশি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে তাড়াতাড়ি কথা ঘোরানোর জন্যে বলল, “নানি তোমার চুলে একটু তেল দিয়ে দিই?”
নানি বললেন, “দে দেখি বোনডি। মাথা দেখি খালি কুটকুট করে।”
তপু বলল, “আমি? আ-আমি তা হলে কী করব?”
টুশি বলল, “তুই নানিকে পান ঘেঁচে দে।”
তপু মনের মতো একটা কাজ পেয়ে খুব খুশি হয়ে উঠল।
একটু পরে দেখা গেল টুশি নানির মাথায় তেল দিয়ে চিরুনি দিয়ে তাঁর শনের মতো সাদা চুল চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে দিচ্ছে–তার কাছে বসে তপু মহা উৎসাহে একটা ছোট পিতলের হামানদিস্তায় পান ঘেঁচে দিচ্ছে।
.
রাত্রিবেলা টুশির বিছানায় নানি যখন ঘুমিয়ে গেছেন তখন তপু এসে টুশিকে ফিসফিস করে বলল, “টু-টু-টুশি আপু।”
“কী হল?”
“কা-কাবিল কোথায় গেছে?”
“আমি কেমন করে বলব! মনে নাই সে ঘুরতে বের হল!”
“অ্যাকসিডেন্ট হয় নাই তো!”
“চিন্তার মাঝে ফেলে দিলি!” টুশি চিন্তিত মুখে বলল, অ্যাক্সডিন্টে হলে কেউ দেখতে পারবে না, হাসপাতালেও নিতে পারবে না।”
টুশির চিন্তার অবসান হল সাথে সাথে দরজায় ধুম ধুম করে কে যেন শব্দ করল। চাচা দরজা খুলে দেখলেন কেউ নেই, এদিক-সেদিক তাকিয়ে কাউকে না দেখে ফিরে এসে বিরক্ত হয়ে চাচিকে বললেন, “ফাজিল ছেলে-ছোঁকড়ার কাজ দেখেছ? এই এত রাতে দরজায় শব্দ করে পালিয়ে গেল!”
চাচি বললেন, “নিশ্চয়ই দোতালার ছেলেটা, চোহরা দেখলেই মনে হয় মহা বদমাইস।”
টুশি আর তপু বুঝতে পারল এটা মোটেও দোতলার পাজি চেহারার ছেলেটা না–এটা কাবিল কোহকাফী, সারা শহর ঘুরে এখন ফিরে এসেছে।
টুশি আর তপু নিশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল, দেখল গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে কাবিল কোহকাফী এসে ঢুকছে। তাকে এখন আর চেনা যায় না–তার পরনে একটা রংচঙে টিশার্ট, জিন্সের প্যান্ট এবং টেনিস শু। মাথায় লাল রঙের একটা বেসবল ক্যাপ। টুশি আর তপুর দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে বলল, “হা হা হা। আজকে কী মজা হয়েছে শুনলে তোমরা হাসতে হাসতে মারা যাবে”
টুশি আর তপু দুজনেই জানে যে কাবিল কোহকাফীর কথা কেউ শুনতে পাচ্ছে না, তাকে কেউ দেখতেও পাচ্ছে না, তার পরেও তারা ভয়ে সিঁটিয়ে রইল, নানি তার গলার স্বর শুনে জেগে ওঠেন কি না সেই ভয়ে বারবার তার দিকে তাকাতে লাগল। নানি বা চাচা-চাচি কেউই অবশ্যি কাবিল কোহকাফীর কথা শুনতে পেলেন। না–কাবিল তাই বলে যেতে লাগল, “বুঝলে তোমরা–আমি রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, হঠাৎ দেখি এক মাস্তান–”
কাবিল হঠাৎ নানিকে দেখে চমকে উঠে গলা নামিয়ে বলল, “ওরে বাবা! এখানে ডাইনি বুড়ি কোথা থেকে এসেছে?”
টুশি রেগে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, “ডাইনি বুড়ি কেন হবে? আমাদের নানি!”