নানি দাঁতহীন মাঢ়ি বের করে হেসে বললেন, “সুইট লাগবে না! দেখছিস না ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়েছি, গায়ে পাউডার দিয়েছি, কপালে টিপ দিয়েছি, লাল শাড়ি পরেছি!”
টুশি বলল, সত্যি সত্যি একদিন তোমার ঠোঁটে লিপস্টিক, গালে পাউডার, কপালে টিপ দিয়ে লাল শাড়ি পরিয়ে দেব!”
তপু বলল, “তোমার নাকি শরীর খারাপ নানি?”
নানি একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, “জোর করে সবাই যদি শরীর খারাপ করিয়ে দেয় তা হলে শরীর ভালো থাকবে কেমন করে?”
টুশি বলল, “তোমাকে দেখে কিন্তু একেবারেই মনে হচ্ছে না তোমার শরীর খারাপ!”
তপু বলল, “আ-আ-আব্বু বলছিল–”
আব্দু কী বলেছিল টুশি তপুকে সেটা বলতে দিল না, বাধা দিয়ে বলল, “নানি তুমি কিন্তু রাত্রে আমার সাথে ঘুমাবে।”
তপু বলল, “না-না–আমার সাথে!”
টুশি বলল, “নানি তুমি যদি তপুর সাথে শোও–সারারাত ঘুমাতে পারবে না। তপু বিছানায় টাকি মাছের মতো লাফায়”
নানি বললেন, “আমার কি আর ঘুম আছে? সারারাত বসে কুটুর কুটুর করি, উলটো তোরাই ঘুমাতে পারবি না।”
.
বাইরের ঘরে যখন নানির সাথে টুশি আর তপু গল্প করছে তখন শোবার ঘরে দরজা বন্ধ করে চাচা-চাচি ফিসফিস করে কথা বলছিলেন। চাচা বললেন, “যাক! বুড়িকে তো নিয়ে আসা গেল। আমি ভেবেছিলাম বুড়ি না আবার বেঁকে বসে।”
চাচি বললেন, “বেঁকে বসবে কেন? নাতির জন্যে মায়ের জান। আর টুশি নিজের নাতনি নামায়া তার জন্যে মনে হয় আরও এক ডিগ্রি বেশি। বললেই চলে আসেন।”
“ভেরি পিকিউলিয়ার। যে-ই দেখে এই মেয়েটাকে পছন্দ করে ফেলে। চেহারায় কোনো ছিরি ছাঁদ নাই কিন্তু তাতে কোনো সমস্যা হয় না, দেখেছ?”
“হুঁ।” চাচি গম্ভীর মুখে বললেন, “ছেলেটাও কেমন বাধ্য দেখেছ? টুশির কথায় ওঠে বসে!”
“যা-ই হোক—-” চাচা ষড়যন্ত্রীদের মতো মুখ করে বললেন, “এখন প্ল্যানের সেকেন্ড পার্ট।”
চাচি শুকনো মুখে বললেন, “আমার কিন্তু কেমন জানি ভয় ভয় করছে!”
চাচা হাত নেড়ে বললেন, “আরে! ভয় কিসের?”
“যদি কিছু-একটা হয়ে যায়?”
“কী হবে? কিচ্ছু হবে না। এরা প্রফেশনাল। এতগুলো টাকা খামোখা দিচ্ছি?”
“তবুও” চাচি ইতস্তত করে বললেন, “মা বুড়ো মানুষ–”
“সেটাই তো কথা!” চাচা উত্তেজিত গলায় বললেন, “তোমার মায়ের যদি বয়স থাকত, সম্পত্তি ভোগ করতে চাইতেন, আমরা কি আপত্তি করতাম? এখন বয়স হয়েছে, এইসবের মায়া ছেড়ে দিতে হবে না?”
“ঠিকই বলেছ।”
“এত বড় একটা বাড়ি এরকম একটা সেন্ট্রাল লোকেশানে, সেইটা নাকি এতিমখানায় দিয়ে দেবে। ভিমরতি আর কারে বলে!”
“তা হলে ঠিক কীভাবে করা হবে?”
“টুশি আর তপু স্কুল থেকে বাসায় আসবে দুইটা তিরিশে। তুমি তাদেরকে খাইয়ে তিনটার ভিতরে বের হয়ে যাবে বাসায় থাকবে খালি বুড়ি, তপু আর টুশি।”
চাচি একটু অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “আমার মাকে তুমি সবসময় বুড়ি ডাকো– এটা ঠিক না!”
“বুড়িকে বুড়ি ডাকব না তো কী ডাকব?”
“নিজের শাশুড়িকে কেউ বুড়ি ডাকে?”
চাচা হাত নেড়ে বললেন, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, এখন এটা নিয়ে একটা ঝগড়া শুরু করে দিও না।”
“হ্যাঁ, বলো তারপর।”
“ঠিক সাড়ে তিনটার সময় পার্টি আসবে। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকবে। আমি একটা চাবি দিয়ে রাখব আগে থেকে।”
“কজয়ন ঢুকবে?”
“তিনজন।” চাচা দাঁত বের করে হেসে তার সিরাজদ্দৌলার মতো গোঁফে হাত বুলিয়ে বললেন, “তিনজনের চেহারা দেখেই বুড়ি–আই মিন তোমার মায়ের না হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়! এই সাইজ একেকজনের, চোখে কালো চশমা, স্কিনটাইট টিশার্ট, হাতে কাটা রাইফেল।”
“তারপর?”
“একজন ধরবে তপুকে, একজন টুশিকে–আরেকজন সেই কাগজ নিয়ে যাবে বুড়ি–আই মিন তোমার মায়ের সামনে। বলবে এই মুহূর্তে সাইন করো, তা না হলে তোমার নাতি আর নাতনির মাথার মাঝে গুলি করে দেব। বুড়ি সুড়সুড় করে সাইন করে দেবে। নিজের মাথায় গুলি করলে বুড়ি ঢিট লেগে থাকবে, কিন্তু নাতির গায়ে হাত দিলে উপায় আছে?” চাচা আনন্দে হা হা করে হাসলেন।
চাচি শুকনো মুখে বললেন, “সব এখন ভালোয় ভালোয় হয়ে গেলে হয়। লোকগুলো কারা? সত্যিকার সন্ত্রাসী না তো?”
“এই কাজের জন্যে কি আর ইউনিভার্সিটির প্রফেসর পাব? তবে চিন্তা করো না, সব নিজেদের লোক।”
“দেখো আবার”।
“বলতে পার পুরো ব্যাপারটা হবে একটা নাটকের মতো। আগে হলে তপুকেও বলে রাখা যেত, যেন ভয় না পায়। এখন এই টুশি মেয়েটা এসে হয়েছে মুশকিল! তপুর আবার নিজের একটা পার্সোনালিটি হয়ে গেছে! ভালোমন্দ বোঝ আরম্ভ করেছে। কী মুশকিল!”
“যা-ই হোক–এখন তো আর কিছু করার নাই! দেখা যাক কী হয়!”
.
রাত্রিবেলা ঘুমানোর আগে টুশি আর তপু তাদের নানির দুই পাশে বসল গল্প শোনার জন্যে। টুশি বলল, “নানি, নানার সাথে তোমার প্রথম দেখা হল কেমন করে সেটা আবার বলো না, প্লিজ!”
নানি মাঢ়ি বের করে হেসে বললেন, “ধুর পাগলি মেয়ে, এক গল্প কতবার বলে!”
টুশি বলল, “শোনা গল্প শুনতেই তো বেশি মজা–আগে থেকে জানি কোন জায়গাটা সবচেয়ে বেশি ইন্টারেস্টিং–”
নানি বললেন, “ধুর বোকা।”
তপু বলল, “তা হলে একটা ভূ-ভূ-ভূতের গল্প বলো।”
টুশি বলল, “হ্যাঁ নানি বলো না। সুইট একটা ভূতের গল্প।”
নানি বললেন, “এই রাতে জিন-ভূতের গল্প শুনলে ভয় পাবি।”
টুশি আর তপু একসাথে বলল, “জিন?” তারা দুজন চোখ বড় বড় করে একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। টুশি ঘুরে নানির দিকে তাকিয়ে বলল, “নানি? তুমি কখনও জিন দেখেছ?”