টুশি চোখ পাকিয়ে কাবিলের দিকে তাকাল কিন্তু কাবিল টুশির দৃষ্টি এড়িয়ে মোমবাতি নেভাতে লাগল। রেহানা আপার কেমন জেদ চেপে গেল, তাঁর চোখমুখ লাল হয়ে ওঠে, হাত কাঁপতে থাকে, জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকেন। একটার পর একটা ম্যাচ জ্বালাতে থাকেন আর কাবিল ফুঁ দিয়ে নেভাতে থাকে। সারা ক্লাসেই কেমন যেন রুদ্ধশ্বাস রুদ্ধশ্বাস ভাব চলে আসে। সবাই নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে–সবাই কেমন জানি ভয় পেয়ে যায়। রেহানা আপা শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়লেন–ম্যাচটা টেবিলের উপর ছুঁড়ে ফেলে নিজের মাথা খামচে গোঙানোর মতো একধরনের শব্দ করতে লাগলেন। কাবিল কোহকাফীকে দৃশ্যটা বেশ উপভোগ করতে দেখা গেল।
কেউ কোনো কথা বলতে সাহস পেল না, শুধু বোকাসোকা ফারিয়া হি হি করে হেসে বলল, “আপা আজকের দিনটা মনে হয় উলটাপালটা। আজকে মনে হয়। বিজ্ঞানের কোনোকিছু কাজ করবে না।”
রেহানা আপা তার টেবিলের উপর রাখা জিনিসপত্রগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “তাই তো দেখছি!”
টুশি একটু আগেই লক্ষ করেছিল–অন্যেরা এখন দেখল যে মোমবাতিটি হঠাৎ করে নিজে নিজে জ্বলে উঠছে–এবং এখন আর নিভে যাচ্ছে না। ব্যাপারটি যে ঘটা উচিত নয় সেটা ফারিয়ার সাদাসিধে মাথায় ঢুকল না, সে আনন্দে হাততালি দিয়ে। বলল, “জ্বলে গেছে! মোমবাতি নিজে থেকে জ্বলে গেছে!”
রেহানা আপা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে একটু ভয়-পাওয়া গলায় বললেন, “কিন্তু এটা নিজে থেকে জ্বলার কথা না! কেমন করে জ্বলল?”
ফারিয়া ব্যাখ্যা দিল, “আপা বিজ্ঞান হচ্ছে ম্যাজিকের মতো–তাই ম্যাজিকের মতো জ্বলে গেছে।”
কেউ কোনো কথা বলল না, তাই ফারিয়া একটু উৎসাহ পেয়ে গেল, নেকু নেকু গলায় বলল, “তাই না আপা?”
ফারিয়ার এই ঢঙের কথা শুনে টুশির পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিল, রেহানা আপা তাকে পছন্দ করে না তাই সে এতক্ষণ কিছু বলছিল না, কিন্তু আর পারল না। বলল, “বিজ্ঞান মোটেও ম্যাজিকের মতো না। বিজ্ঞান হচ্ছে বিজ্ঞানের মতো।”
ফারিয়ার কথার কেউ প্রতিবাদ করবে, তাও তার প্রিয় রেহানা আপনার ক্লাসে সেটা সে বিশ্বাস করতে পারল না। নেকু নেকু গলায় বলল, “তা হলে কেমন করে এগুলো হচ্ছে?”
“আর হবে না।”
“হবে না?”
“না।”
রেহানা আপা ভুরু কুঁচকে বললেন, “আর হবে না?”
টুসি আমতা-আমতা করে বলল, “আমাকে যদি করতে দেন তা হলে আর হবে না।”
“কেন?”
“বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করতে হয় আপা। বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করলে সবকিছু ঠিকঠাক হয়।”
রেহানা আপা খানিকক্ষণ টুশির দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর বললেন, “আসো।”
টুশি টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল, সবাই অবাক হয়ে দেখল সে কনুইটা হঠাৎ করে পিছনে সজোরে নিয়ে যায়, মানুষ কনুই দিয়ে কারও পেটে গুতো মারতে হলে এরকম করে–কিন্তু এখানে কোনো মানুষ নেই, সে কেন এরকম করছে কে জানে! কাবিল কোহকাফী পেটে গুঁতো খেয়ে একটু সরে গিয়েছে, টুশি তখন টেবিলে এগিয়ে যায়, চুম্বকটা হাতে নিয়ে বলল, “এই দ্যাখোচুম্বক চককে আকর্ষণ করে না, পানিকেও আকর্ষণ করে না। শুধু লোহাকে আকর্ষণ করে।”
সবাই দেখল চক লাফিয়ে গেল না, পানিও ছলকে উঠল না, চুম্বকটা শুধু লোহাগুলোকে আকর্ষণ করল। পেন্ডুলামটাও ঠিক ঠিক দুলতে শুরু করল, নাচানাচি করল না। মোমবাতির শিখাটাও নিভে গেল না, টেস্ট টিউবের মাঝে এক টুকরো বরফ একটা তার দিয়ে নিচে আটকে রেখে উপরের পানিটিও রেহানা আপা ফুটিয়ে ফেলতে পারলেন। কাবিল কোহকাফী টুশিকে বিরক্ত করার চেষ্টা করল না, একটু কাছে থেকে এসে দেখার চেষ্টা করছিল কিন্তু টুশি কোনো ঝুঁকি নিল না, হাতের কনুই দিয়ে শরীরের শক্তি দিয়ে গুঁতো মেরে তাকে সরিয়ে রাখল।
তার এই অঙ্গভঙ্গি দেখে জাবেদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “টুশি, তুমি একটু পরে পরে তোমার কনুই দিয়ে ওরকম করছ কেন?”
“কে বলেছে একটু পরে পরে করছি?”
“হ্যাঁ করেছ। এই যে একটু আগে করলে!”
“ও আচ্ছা ওইটা? ওইটা মনের আনন্দে করেছি!”
“মনের আনন্দে?”
“হ্যাঁ। মনের আনন্দে কেউ হাততালি দেয়, কেউ হাত উপরে তুলে বলে ইয়াহু, আমি এরকম করি!” টুশি ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যে আরও একবার করে দেখাল–কাবিল ছাড়াই!
“তোমার মনে এত আনন্দ হচ্ছে কেন?”
“বিজ্ঞানের এক্সপেরিমেন্ট দেখলে আমার মনে খুব আনন্দ হয়!” টুশি সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বলল, “তোমাদের হয় না?”
রেহানা আপা সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, তাই সবাই জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “হয়।”
টুশি গম্ভীর হয়ে বলল, “ভেরি গুড।”
রেহানা আপা টুশি নামের এই একটু বিচিত্র মেয়েটাকে ভালো করে এবং একটু অন্যরকমভাবে লক্ষ করলেন।
ঠিক কী কারণ জানা নেই তাই দেখে ফারিয়া একেবারে জ্বলেপুড়ে কাবাব হয়ে গেল!
০৯. নানি
বাসায় এসে তপু এবং টুশি আবিষ্কার করল তপুর নানি বাইরের ঘরের সোফায় দুই পা তুলে বসে আছেন। তপুর নানি আগেও এক দুইবার এই বাসায় এসেছেন, একেবারে থুরথুরে বুড়ো, মাথার চুল শনের মতো সাদা কিন্তু খুব হাসিখুশি। টুশি আগেও লক্ষ করেছে মানুষ দুরকমভাবে বুড়ো হয়, এক ধরনের মানুষকে দেখে মনে হয় বুড়ো অন্য ধরনের মানুষকে দেখে মনে হয় শিশু। তপুর নানি দ্বিতীয় ধরনের তাকে দেখে কেমন যেন ছোট বাচ্চার মতো মনে হয়। টুশির বয়সী ছেলেমেয়েরা সাধারণত বুড়ো মানুষদের পছন্দ করে না, কিন্তু টুশির কথা আলাদা। প্রায় সারাটা জীবনই সে তার নানার সাথে কাটিয়েছে তাই বুড়ো মানুষদের তার খুব ভালো লাগে। তাই নানিকে দেখে তপু যেটুকু খুশি হলো টুশি খুশি হলো আরও বেশি! সে ছুটে গিয়ে নানিকে জড়িয়ে ধরে বলল, “নানি–তোমাকে দেখতে আজকে কত। সুইট লাগছে।”