টুশি চোখ কপালে তুলে বলল, “তুমি মরে যাবে কেন?”
নানা হা হা করে হেসে বললেন, “মানুষ বুড়ো হয়ে যে মারা যায় তুই জানিস না?”
“তুমি কি বুড়ো হয়েছ নাকি?”
নানা হাত তুলে বললেন, “ঠিক আছে ঠিক আছে, আমি বুড়ো হই নাই। কিন্তু কম বয়সী মানুষ মারা যায় না? তোর বাবা-মা মারা যায় নাই?”
“সেটা তো অ্যাকসিডেন্ট।”
“আমার কখনও অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে না?”
টুশি এবারে সোজাসুজি উত্তর দিতে পারল না, বলল, “চেষ্টা করো যেন অ্যাকসিডেন্ট না হয়। সাবধানে থাকো।”
নানা সিঁড়ি দিয়ে দোতালায় উঠতে উঠতে আবার ঘ্যাস ঘ্যাস করে দাড়ি চুলকাতে লাগলেন। টুশি চোখের কোনা দিয়ে নানাকে লক্ষ করে বলল, “কী বলতে চাইছ বলে ফেলো।”
নানা একটু অবাক হয়ে বললেন, “আমি কিছু বলতে চাই তুই কেমন করে জানিস?”
“যখন তুমি কিছু বলতে চাও কিন্তু ঠিক জান না কীভাবে বলবে তখন তুমি এইভাবে ঘ্যাস ঘ্যাস করে দাড়ি চুলকাও।”
নানা দাড়ি চুলকানো বন্ধ করে বললেন, “তাই নাকি?”
“হ্যাঁ।”
নানা খানিকক্ষণ টুশির দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “তুই ঠিকই ধরেছিস। কয়দিন থেকেই তোক একটা কথা বলব ভাবছি।”
“কী কথা?”
নানা দোতালার বারান্দা দিয়ে হেঁটে সিন্দুকের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে চাবি দিয়ে তালা খুলতে খুলতে বললেন, “তুই স্বীকার করিস আর না-ই করিস–আমি আসলে বুড়ো হয়েছি, যে-কোনো দিন মরে যাব, তখন তোর কী হবে?”
টুশি ভয়ে ভয়ে নানার দিকে তাকাল, বলল, “কী হবে?”
“তা ছাড়া তোর মতো এরকম হাট্টা-কাট্টা-টাটকা-মাটকা একটা মেয়ে আমর মতো বুড়ো মানুষের সাথে থাকবে সেটাও ঠিক না। একেবারেই ঠিক না–”
টুশি চোখ পাকিয়ে কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, নানা সুযোগ দিলেন না, বললেন, “আসলে তোর যেটা দরকার সেটা হচ্ছে একটা ফ্যামিলি। যেখানে বাবা মা আছে, ভাই-বোন আছে, বাচ্চাকাচ্চা আছে। সত্যিকারের একটা ফ্যামিলি।”
“ফ্যামিলি?”
“হ্যাঁ।”
“ফ্যামিলি কি ভাড়া পাওয়া যায়? তুমি কি ভাড়া করবে?”
নানা আবার হা হা করে হাসলেন, বললেন, “না পাগলি মেয়ে, ফ্যামিলি ভাড়া পাওয়া যায় না। কিন্তু খুঁজে বের করা যায়।” একটু থেমে বললেন, “আমি খুঁজে বের করেছি।”
টুশি একেবারে ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল, চিৎকার করে বলল, “কী বললে তুমি? কী বললে?”
সিন্দুকের ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালিয়ে নানা বললেন, “বলেছি যে তোর জন্যে একটা ফ্যামিলি ঠিক করেছি। সত্যিকারের ফ্যামিলি। একটা বাবা-মা আর ছোট একটা ভাই। তুই তাদের সাথে থাকবি।”
টুশি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না, খানিকক্ষণ বিস্ফারিত চোখে নানার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বাঘের মতো গর্জন করে বলল, “তুমি আমার জন্যে একটা ফ্যামিলি ঠিক করেছ? আমি কী তোমার এত ঝামেলা করছি যে আমাকে বিদায় করে দিতে হবে?”
নানা অপ্রস্তুত হয়ে ঘ্যাস ঘ্যাস করে দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বললেন, “আহা হা–রাগ করিস না, পাগলি মেয়ে। আমি কী তোকে বিদায় করে দিতে চাইছি? তুই ছাড়া আমার কে আছে! কিন্তু আমি যদি মরে যাই”।
টুশি হুংকার দিয়ে বলল, “তুমি মরবে না।”
নানা হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, “ঠিক আছে আমি মরব না।”
“অন্য একটা ফ্যামিলি আমাকে নেবে কেন? কালো কুচ্ছিৎ একটা মেয়ে আমি–আমাকে দেখলে মানুষ দৌড়ে পালায়”
নানা টুশির ঘাড় ধরে একটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “বাজে কথা বলবি না, ঘাড় ভেঙে ফেলব।”
“কখন বাজে কথা বললাম? আমার চেহারা যে কালো কুচ্ছিৎ তুমি জান না?” নানা টুশির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “ছি টুশি ছি! এইভাবে কথা বলে না।
তোর গায়ের রংটা হয়তো ফরসা না কিন্তু তুই কালো কুচ্ছিৎ হবি কেন? আমার কাছে তুই হচ্ছিস পৃথিবীর সবচেয়ে রূপসী মেয়ে–”
“আমাকে দেখে দেখে তোমার অভ্যাস হয়ে গেছে তাই এই কথা বলছ। সেদিন কী হয়েছে জান?”
“জানি না।” নানা ভয়ে ভয়ে বললেন, “কী হয়েছে?”
“স্কুল থেকে আসার সময় একটা রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম যাবে কি না, সে রাজি হল না। সায়মা এসে জিজ্ঞেস করতেই রাজি হয়ে গেল। কেন রাজি হল জান? কারণ আমার চেহারা খারাপ, সায়মার চেহারা ভালো।”
“ধুর বোকা মেয়ে!” নানা হাত দিয়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, “পাগলি মেয়ে। কী বলতে কী বলিস! যত্তো সব–”
টুশি মুখ শক্ত করে বলল, “যাদের চেহারা ভালো না তাদের মনে অনেক কষ্ট থাকে, বুঝেছ? আমার চেহারা যদি খুব সুন্দর হত তোমার সেই ভাড়া-করা ফ্যামিলি আমাকে দেখে বলত, আহা, টুশি কী ভালো মেয়ে! এই ভালো মেয়েটাকে আদর করে যত্ন করে নিজের মেয়ের মতো করে রাখব। এখন আমাকে দেখে কী বলবে জান?”
নানা জানতে চাচ্ছিলেন না, কিন্তু টুশি তাকে সুযোগ দিল না, মেঘের মতো গর্জন করে বলল, “এখন আমাকে দেখে বলবে, এই মেয়েটা দেখতে এত খারাপ, এর স্বভাবও নিশ্চয়ই খারাপ। পাজি এই মেয়েটাকে আচ্ছামতো শিক্ষা দিতে হবে। টাইট করে ছেড়ে দিতে হবে।”
নানা একধরনের আতঙ্ক নিয়ে টুশির দিকে তাকিয়ে রইলেন, খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বললেন, “এইজন্যে বলছিলাম তোর থাকা দরকার একটা সত্যিকার ফ্যামিলির সাথে। যেখানে সত্যিকারের বাবা আছে, মা আছে, ছোট ভাই আছে। আমার মতো বুড়ো মানুষের সাথে থেকে তোর কী ক্ষতি হয়েছে দেখেছিস?”
“কী ক্ষতি হয়েছে?”