তোর সমস্যা নিয়ে ভাবছি।
আমার? আমার আবার কি সমস্যা?
দিলু বেশ অবাক হলো। ওসমান সাহেব নরম গলায় বললেন—ঐ যে পানি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেবার ব্যাপারটা।
ও আল্লা, তুমি এটা নিয়ে এখনো ভাবছ?
হ্যাঁ, ভাবছি।
বলে দেব?
না বলিস না। নিজেই বের করব।
আরেকটা সহজ ধাঁধা ধরব? জামিল ভাইয়ের কাছ থেকে শিখেছি। দারুণ মজার।
না, আর না। যেটা দিয়েছিস সেটাই আগে সল্ভ করি।
দিলু হাসলো খিলখিল করে।
হাসছিস কেন?
বলা যাবে না।
মা আলিমকে একটু আসতে বল।
আমি পারব না বাবা।
পারবি নে কেন?
কি অন্ধকার দেখছো না? ভয় ভয় লাগে। বাবা!
কি?
একটা ভূতের গল্প শুনবে। সত্যি গল্প। জামিল ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছি। উনার নিজের লাইফের ঘটনা।
ওসমান সাহেব কিছু বললেন না। পাইল ধরাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। খুব হাওয়া দেশলাইয়ের কাঠি নিভে নিভে যাচ্ছে।
বাবা বলব?
বল।
দিলু তার বাবার কাছে ঘেঁষে এলো। একটা হাত রাখলো বাবার হাতে। গলার স্বর নিচু করে গল্প শুরু করলো।
বুঝলে বাবা, তখন শ্রাবণ মাস। জামিল ভাই গিয়েছেন তার বন্ধুর বাড়ি। গ্রামের দোতলা বাড়ি। জামিল ভাইকে যে ঘরটায় থাকতে দেয়া হয়েছে তার জানালাগুলো খুব ছোট ছোট। বাবা শুনছ তো?
শুনছি।
তাহলে হুঁ বলবে একটু পর পর। না বললে মনে হবে গল্প শুনছ না।
ঠিক আছে বলব। তারপর কি হলো?
মাঝখানে হঠাৎ খুব ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলো। ঘরে হ্যারিকেন ছিলো, হ্যারিকেনটা গেলো নিভে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিচ্ছু দেখা যায় না।
তারপর?
তারপর হলো কি শুন। কে যেন দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলো। জামিল ভাই বললেন—কে? একজন মেয়েমানুষের গলা শোনা গেলো—দয়া করে দরজা খুলুন।
তারপর কি হলো?
জামিল ভাই দরজা খুলতেই ঘরে একটা মেয়ে ঢুকলো সতেরো-আঠারো বছর বয়স। বাইরে এত ঝড়-বৃষ্টি কিন্তু মেয়েটি খটখটে শুকনো।
ওসমান সাহেব বললেন—ঘুটঘুটে অন্ধকারে জামিল কি করে দেখলো মেয়েটি শুকনো এবং বুঝলই বা কিরে ওর বয়স সতেরো-আঠারো? দিলু থমকে গেলো। এটা সে ভাবেনি। ওসমান সাহেব হাসিমুখে বললেন—গল্পটার মধ্যে একটা ফাঁকি আছে। তাই না দিলু? দিলু জবাব দিলো না। তার একটূ মন খারাপ হয়ে গেলো। ওসমান সাহেব বললেন—গল্পটা শেষ কর।
না থাক!
থাকবে কেন? বাকিটা শুনি।
তোমাকে শুনতে হবে না।
দিলুর গলার স্বর ভারী। যেন সে এক্ষুণি কেঁদে ফেলবে। সে উঠে দাঁড়ালো।
কোথায় যাচ্ছিস?
জামিল ভাইকে কথাটা জিজ্ঞেস করে আসি।
পরে জিজ্ঞেস করলেও হবে।
না আমি এখন জিজ্ঞেস করব। কেন সে আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলবে?
গল্প তো গল্প। গল্প কখনো সত্যি হয়?
জামিল ভাই বলেছিলো এটা সত্যি গল্প।
দিলু প্রথমে গেলো খাবার ঘরে। সেখানে একজন অপরিচিত রোগা লোক হ্যাজাক লাইট ঠিক করতে চেষ্টা করছে। এক একবার দপ করে আগুন জ্বলে উঠে, লোকটি—“খাইছেরে” বলে এক লাফে পেছনে সরে। ব্যাপারটা দিলুর কাছে খুব মজার লাগলো। দিলু হাসিমুখে বললো—আপনার কি নাম?
আমার নাম বাদলা।
বাদলা আবার নাম হয়?
বাপ-মায় দিছে কি করমু কন।
তারা বোধ হয় নাম রেখেছিল বাদল।
দিলুর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে হ্যাজাকটা ঠিক হয়ে গেলো—বাদলা দাঁত বের করে বললো—আফা আপনের খুব ভয়। দিলু বললো—আপনি কি জামিল ভাইকে দেখেছেন? ঐযে লম্বা। গায়ে পাঞ্জাবি আর ক্রিম কালারের চাদর।
জ্বি দেখছি।
কোথায় দেখেছেন?
এই সাব আরেকজন কোট পরা সাব বইসা আছে পুকুর ঘাটে। গফ করতাছে।
আপনি যানতো জামিল ভাইকে ডেকে নিয়ে আসুন। বলবেন—দিলু আপনাকে ডাকছে। আমার নাম দিলু। দিলশাদ থেকে দিলু।
লোকটি চলে গেলো। দিলু মুখ গম্ভীর করে বসে রইলো। রাত বেশী হয়নি। মাত্র আটটা কিন্তু মনে হচ্ছে গভীর রাত। ঝিঁঝিঁ ডাকছে চারদিকে। বাবুর কান্না শোনা যাচ্ছে। সে সারাদিন ঘুমিয়েছে কাজেই সারা রাত সে জেগে থাকবে। একটু পরে পরে কাঁদবে। মা-কে কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে হবে। দিলু শুনলো মা তাকে গল্প বলার চেষ্টা করছেন। তুলা রাশি কন্যার গল্প। এই গল্পটি ছোটবেলায় সেও শুনেছে। এক রাজকন্যার ওজন মাত্র এক ছটাক। কিন্তু এক রাত্রে হঠাৎ তার ওজন বেড়ে গেলো।
কি ব্যাপার দিলু। জরুরী তলব কেন?
জামিল ভাই, আপনি আমাকে মিথ্যে কথা বললেন কেন? কেউ আমাকে মিথ্যে বললে আমার খুব খারাপ লাগে।
কোনটা মিথ্যে বলেছি বলেন তো? মিথ্যে তো আমি তেমন বলি না।
ঐ যে একটা সত্যি ভূতের গল্প বললেন—ওটা আসলে মিথ্যে ভূতের গল্প।
কোন গল্পটি?
ঐ যে বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছেন। ঝড়-বৃষ্টির সময়। ষোল-সতেরো বছরের একটা মেয়ে ঘরে ঢুকলো।
হ্যাঁ মনে পড়েছে। মিথ্যে হবে কেন? ওটা সত্যি গল্প।
না, সত্যি না। এই অন্ধকারে আপনি কি করে বুঝলেন ওর বয়স ষোল-সতেরো। ওর কাপড় ভেজা না।
জামিল গম্ভীর গলায় বললো—ঐ রাতে খুব ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিলো। ঝড়ের সময় ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকায়। বিদ্যুতের আলো শহরের ইলেকট্রিকের আলোয়ে চেয়েও কড়া।
দিলু তাকিয়ে রইলো চোখ বড় করে। জামিল বললো—তবে মেয়েটির বয়সের ব্যাপারটা আমার কল্পনা। আমি নিজে তখন অল্পবয়স্ক ছিলাম, কাজেই সব মেয়ের বয়স মনে হতো ষোল-সতেরো।
দিলু কিছু বললো না।
কি এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না?
হচ্ছে। জামিল ভাই—
বল।
আরেকটা সত্যি গল্প বলেন।
আরেক দিন বলব!
জামিল ভাই, আপনি কি আমার ওপর রাগ করেছেন?
না, রাগ করব কেন?
দিলু হঠাৎ উঠে ঘর ছেড়ে চলে গেলো। জামিল হাসলো। দিলু নিশাতের মত হয়নি। সে হয়ত এখন কিছুক্ষণ কাঁদবে।
আমার আছে জল – ০৭ম পরিচ্ছেদ
রাতের খাবার দেয়া হলো ন’টার দিকে। দেখা গেলো কারোরই খাওয়ার দিকে মন নেই। শুধু সাব্বির, খাবার দেয়া হয়েছে শোনামাত্র, এসে বসেছে এবং খেতে শুরু করেছে। রেহানা বাবুকে কিছু একটা মুখে দেয়াবার জন্য আবার ঘরে এসে সাব্বিরের একা একা খাওয়ার দৃশ্যটি দেখলেন। সাব্বির ঘন ঘন পানি খাচ্ছে। রেহানা বললেন—খুব ঝাল হয়ে গেছে নাকি?