আমি ওর সঙ্গেই এখানে আসতে চেয়েছিলাম, আর কারো সঙ্গে নয়।
ভেবে নাও ও তোমার সঙ্গেই আছে।
সব কিছু কি ভেবে নেওয়া যায়। জীবন এত সহজ মনে করেন?
জীবন সহজও নয় জটিলও নয়। জীবন জীবনের মতো। আমরাই একে জটিল করি—সহজ করি। তুমি একে ক্রমেই জটিল করছো।
নিশাত চুপ করে গেলো। জামিল হালকা সুরে বললো—দুঃখ শুধু কি তোমার একার? আমাদের সবারই দুঃখ আছে।
আপনার আবার কিসের দুঃখ? দুঃখের আপনি কি জানেন?
নিশাত উঠে দাঁড়ালো। বাবু জেগে উঠে কাঁদছে। কে একজন এসে বারান্দায় একটি হ্যারিকেন রেখে গেলো। হ্যারিকেনের আলোয় সব কেমন অদ্ভুত লাগছে।
জামিল সাহেব, আপনি যেভাবে বসে আছেন বসে থাকুন। একটা ছবি তুলব। নড়বেন না, শাটার স্পীড খুব কম।
অনেকখানি সময় নিয়ে সাব্বির ছবি তুললো।
আমার আছে জল – ০৬ষ্ঠ পরিচ্ছেদ
পানি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেয়ার ধাঁধাটি ওসমান সাহেবের মাথায় ঘুরতে শুরু করেছে দুপুর থেকে। ওসমান সাহেব নিজের ওপরই বিরক্ত হচ্ছিলেন। ধাঁধার মত সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে এই বয়সে কেউ এমন চিন্তিত হয়ে পড়ে না। কিন্তু তিনি হচ্ছেন। এটা কি বয়সজনিত স্থবিরতা? তিনি কেমন যেন চ্যালেঞ্জ বোধ করছেন। এর মধ্যে চ্যালেঞ্জ বোধ করার কি আছে? ধাঁধার উত্তর জানতেই হবে এমন কোন কথা নেই।
তিনি পাইপ হাতে বারান্দায় এসে বসলেন। তাঁর গায়ে ভারী একটা ওভারকোট। গলায় মাফলার। তবু তাঁর শীত করতে লাগলো। বয়স! বয়স বাড়ছে। এখন একদিন একটা মাইল্ড স্ট্রোক হবে। তার লক্ষণও টের পাওয়া যাচ্ছে। ব্লাড প্রেসার বেড়েছে। ঘুম কমে গেছে। খিদে কমে গেছে। চিন্তাও পরিস্কার করতে পারছেন না। পারলে এই সহজ ধাঁধার জবাব বের করতে পারতেন। কিংবা কে জানে এটা হয়তো সহজ নয়। হয়তো জটিল।
বারান্দায় রেহানা বাবুকে কোলে নিয়ে বসেছিলেন। ওসমান সাহেব রেহানার ডান দিকের খালি চেয়ারটিতে বসলেন। রেহানা বললেন—নিশাতের বেশ জ্বর।
তাই নাই?
একশ’ দুই-টুই হবে।
থার্মোমিটার দিয়ে দেখেছো?
না।
তাহলে বুঝলে কিভাবে একশ’ দুই?
অনুমান করে বলছি।
অনুমান করে আমাকে কিছু বলবে না।
তুমি এরকম করছ কেন?
কি রকম করছি?
এত মেজাজ দেখাচ্ছ কেন?
মেজাজ কোথায় দেখালাম?
থানার ওসি ভদ্রলোকের সঙ্গে এমন খারাপ ব্যবহার করলে কেন?
খারাপ ব্যবহার তো করিনি। আমি বিরক্ত হয়েছি। এই বিরক্তির ব্যাপারটি তাকে জানিয়েছি। সে জানে আজ ভোরে আমি আসব কিন্তু সে স্টেশনে আসেনি। আমি ডাকবাংলোয় পৌঁছানোর পর সে এসেছে। আমাকে সে কি ভেবেছে?
তুমি কোন সরকারী ট্যুরে আসনি। তুমি ছুটি কাটাতে এসেছো। কেন সে আসবে?
সে আসবে। তার পুরো দলবল নিয়ে আসবে কারণ আমি পুলিশের আই জি।
রেহানা একবার ভাবলেন বলবেন না। শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললেন। এবং বললেন বেশ তীক্ষ্ণ কণ্ঠেই,–তুমি এখন আর আই জি নও। রিটায়ারমেণ্ট নিয়েছো। রিটায়ারমেণ্টের আগের পাওনা ছুটি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ। তুমি পুলিশের আই জি এটা এখন যত তাড়াতাড়ি ভুলতে পার ততই ভালো।
ওসমান সাহেবের পাইপ নিভে গেছে। নিভে যাওয়া পাইপ হাতে তিনি মূর্তির মত দীর্ঘ সময় বসে রইলেন। রেহানা শীতল স্বরে বললেন—এখন আর তোমাকে দেখামাত্র পুলিশের অফিসাররা ছুটোছুটি করবে না। এটা মানসিকভাবে একসেপ্ট করার চেষ্টা কর। তোমার জন্যেও ভাল। আমাদের সবার জন্যেও ভালো। ওসমান সাহেব জবাব দিলেন না। দূরের রেণ্ট্রি গাছগুলির দিকে তাকিয়ে রইলেন। রেহানার মনে হলো এই কথাগুলি হয়ত না বললেও চলতো। তিনি গলার স্বর স্বাভাবিক করতে করতে বললেন—চা খাবে?
না।
শীতের মধ্যে ভাল লাগবে।
আমাকে এক ঢোক হুইস্কি দিতে বল।
হুইস্কি এখানে কোথায় পাবে?
আছে, আলিম নিয়ে এসেছে। আলিমকে বল।
আলিম ওসমান সাহেবের বাসায় গত বিশ বৎসর ধরে আছে। তার বয়স ওসমান সাহেবের চেয়েও বেশী কিন্তু গৃহভৃত্যদের কোন পেনসনের ব্যবস্থা নেই, কাজেই তাকে একদিন আগেই রান্নার কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে নীলগঞ্জে আসতে হয়েছে। আজ প্রচণ্ড দাঁতব্যথা থাকা সত্বেও সারাদিন রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। রেহানা বললেন—আলিম শুয়ে আছে। ওর শরীর ভাল না। তাছাড়া এখানে এসব করতে পারবে না।
কেন, এখানে অসুবিধা কি?
অসুবিধা আছে। ঘরে তুমি যা কর, তাই বলে বাইরে এসেও করবে?
রেহানা, এখানে ছুটি কাটাতে এসেছি। রিলাক্স করতে এসেছি।
তুমি একা আসনি। তোমার সঙ্গে বাইরের মানুষ আছে।
বাইরের মানুষ এখানে কেউ না। জামিল ঘরের ছেলে, সে আমার অভ্যাস জানে আর সাব্বির এগারো বছর ধরে বাইরে আছে।
আমি তোমাকে এখন মদ খেতে দেব না।
রেহানা বাবুকে কোলে নিয়ে উঠে গেলেন। যাবার সময় হ্যারিকেন হাতে করে তুলে নিয়ে গেলেন। ওসমান সাহেব অন্ধকার বারান্দায় একা একা বসে রইলেন। এখানে মশা আছে। বন্য মশা। মানুষ কামড়িয়ে অভ্যেস নেই বোধ হয়। কামড়াচ্ছে না, শুধু বিরক্ত করছে। ওসমান সাহেব আবার ধাঁধা নিয়ে ভাবতে বসলেন। পানি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিতে হবে। শুধু হাতে নিতে হবে এবং একবারে নিতে হবে। কোন মানে হয়?
বাবা, তুমি অন্ধকারে বসে কি করছ?
দিলু ঢুকলো। ওসমান সাহেব মিষ্টি একটা গন্ধ পেলেন। দিলু পাউডার মেখেছে কিংবা সেন্ট-টেন্ট দিয়েছে। গন্ধটা হালকা এবং চেনা। পরিচিত কোন ফুলের গন্ধ। কি ফুল ওসমান সাহেব সেটা মনে করতে পারলেন না। অনেকদিন সচেতনভাবে কোন ফুলের গন্ধ নেয়া হয় নি। দিলু তার পাশের চেয়ারে বসলো এবং আবার বললো—অন্ধকারে একা একা বসে কি করছ?