কেন?
অষুধ খেয়ে তোর মুখ তেতো হয়ে আছে না?
মা, আমার জন্যে তোমাকে এত ভাবতে হবে না।
দিলু ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছিলো। ওসমান সাহেব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন তিনি দিলুর কথা বেশ মন দিয়ে শুনছেন এবং তাঁর ভালোই লাগছে।
সোগাগী নাম কেমন করে হয়েছে শুনবে বাবা?
বল শুনি।
আমার দিকে তাকাও বলছি। অন্যদিকে তাকিয়ে আছ কেন?
ওসমান সাহেব মেয়ের দিকে তাকালেন। দিলু হাত নেড়ে নেড়ে গল্পটা বললো। ওসমান সাহেব বললেন—এই জাতীয় মীথ প্রায় সব পুকুর সম্পর্কেই থাকে। এটা ঠিক নয়। একটা নির্দিষ্ট গভীরতায় মাটি কাটলেই পানি আসবে। শীতের সময় যদি নাও আসে বর্ষার সময় বৃষ্টির পানি ভরে যাবে। দিলুর মন খারাপ হলো। গল্পটা তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হচ্ছে। ওসমান সাহেব বললেন—রাজার মেয়ের নাম সোহাগী এটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়।
বিশ্বাসযোগ্য নয় কেন?
রাজাদের মেয়ের এমন সাধারণ নাম থাকে না। ওদের গালভরা নাম থাকে। ফুলকুমার, রূপকুমারী, নূরজাহান, নূরমহল।
দিলুর মন বেশ খারাপ হলো। সে মুখ ফিরিয়ে বাইরে তাকালো এবং অবাক হয়ে দেখলো জামিল ভাই আসছেন।
ক্যাসেট প্লেয়ারটা তোর কাছে?
হ্যাঁ।
ওটা নিতে এসেছি।
জামিল গরুর গাড়ীর পেছনে পা ঝুলিয়ে বসলো।
দিলু, ভালো দেখে কয়টা ক্যাসেট দে।
রবীন্দ্র সঙ্গীত?
না হিন্দী-ফিন্দী।
দিলু ক্যাসেট বাছতে বাছতে বললো—বাবা কিন্তু সোহাগী পুকুরের গল্পটা বিশ্বাস করেন নি। বাবা বলছেন মাটি কিছু দূর খুঁড়লেই পানি আসবে।
এটা ঠিক নয়। ঢাকা আর্ট কলেজে একটা বিরাট পুকুর আছে। খুব গভীর। বর্ষাকালে পর্যন্ত সেখানে এক ফোঁটা পানি থাকে না।
সত্যি?
হ্যাঁ। এবং অমাবশ্যা-পূর্ণিয়ায় কেউ যদি সেই পুকুরে নামে তাহলে খিলখিল হাসির শব্দ শোনে।
ওসমান সাহেব পাইপে তামাক ভরতে ভরতে বললেন—জামিল, সত্যি নাকি?
পুকুরে পানি নেই বর্ষাকালেও এটা সত্যি, আমি নিজে দেখেছি। তবে হাসির কথাটা জানি না, ওটা বানানোও হতে পারে।
দিলু বললো—আমাকে ঐ পুকুরটা দেখাবেন?
একদিন গিয়ে দেখে এলেই হয়। তোদের বাসার কাছেই তো।
জামিল ক্যাসেট প্লেয়ার নিয়ে নেমে গেলো। দিলু বললো—জামিল ভাই অনেক কিছু জানে। ওসমান সাহেব জবাব দিলেন না।
জামিল ভাই, আমাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করেছিলো, সেটা দারুণ মজার, তোমাকে জিজ্ঞেস করব?
কর।
আচ্ছা মনে কর তোমার কাছে দশ সের পানি দেয়া হলো। এখন তুমি কি পারবে এই দশ সের পানি একবার এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিতে। বালতি টালতি কিছু ব্যবহার করতে পারবে না। শুধু হাত দিয়ে নেবে এবং একবারে নেবে।
ওসমান সাহেব ভ্রু কুঁচকে ভাবতে লাগলেন। দিলু মিটি মিটি হাসতে হাসতে বললো—খুব সহজ বাবা। চেষ্টা করলেই পারবে। একটু হিন্টস দেব?
না হিন্টস দিতে হবে না।
ওসমান সাহেব সত্যিই গভীরভাবে চিন্তা করতে শুরু করলেন।
জামিল নিজের গাড়িতে ফিরে এসে দেখে সাব্বির উঠে বসেছে। ক্যামেরা নিয়ে কি সব যেন করছে।
কি ঘুম হয়ে গেলো?
হ্যাঁ।
কি করছেন?
একটা ব্লু ফিল্টার লাগাচ্ছি।
ব্লু ফিল্টার দিয়ে কি হয়?
দিনের বেলা ছবি তুললে মনে হয় জ্যোৎস্না রাত্রিরে ছবি তোলা হয়েছে।
আপনি নিজে তো একজন ইন্জিনিয়ার?
জ্বি।
আপনাকে দেখে মনে হয় ছবি তোলাই আপনার একমাত্র কাজ।
এটা আমার একটা হবি।
খুব বড় ধরনের হবি মনে হচ্ছে?
সাব্বির শান্ত স্বরে বললো—আমি কিন্তু খুব নামকরা ফটোগ্রাফার। আমার নিজের তোলা ছবি নিয়ে আমেরিকান এক পাবলিশার একটি বই বের করেছে, নাম হচ্ছে—অন দি টপ অব দি ওয়ার্লড।
আপনার কাছে কপি আছে?
আছে, দিচ্ছি।
সাব্বির আহমেদ তিনশ পৃষ্ঠার একটি বই বের করলো তার স্যুটকেস থেকে। জামিলের বিস্ময়ের সীমা রইলো না।
এই বইটির কথা কি দিলুরা জানে?
না। নিজের কথা বলতে ভাল লাগে না।
সাব্বির ছবি তুলতে শুরু করলো। ক্যামেরার শাটার পড়ছে। কোন কিছু যে সে দেখছে মন দিয়ে তা মনে হচ্ছে না।
একটা গ্রাম্য বধু লম্বা ঘোমটা মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শাটার পড়তে লাগলো ঘটাঘট।
ছাগলের গলার দড়ি ধরে একটা আট-ন’ বছরের বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে। ঘটাঘট শাটার পড়তে শুরু করলো। জামিল বললো—এই ছবিটা আপনার ভাল হবে না। জোছনা রাতে কেউ ছাগল চড়াতে বের হয় না। আপনি বরং ব্লু-ফিল্টার বদলে নিন।
সাব্বির হালকা গলায় বললো—উল্টোটাও হতে পারে। ছবি দেখে মনে হতে পারে রাতের রহস্যময়তায় মুগ্ধ হয়ে একটা শিশু তার পোষা প্রাণীটি নিয়ে বের হয়েছে। দু’জনের চোখেই বিস্ময় ও ভয়, তাদের ঘিরে আছে জোছনা।
আপনি কি ফটোগ্রাফার না কবি?
আমি একজন ইন্জিনিয়ার।
জামিল বইটির পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললো—আপনার এই বইটিতে তো মানুষের কোন ছবি নেই। শুধুই জড়বস্তুর ছবি। মানুষের ছবি বেশী তোলেন না?
আমার অন্য একটি বইয়ে মানুষের ছবি আছে। সবই অবশ্যি ‘নূড’ ছবি।
বইটি আছে?
আছে।
আমেরিকায় আপনি কতদিন ধরে আছেন?
প্রায় এগারো বছর।
দেশে ফিরবেন না?
না।
কেন?
থাকবার জন্য ঐ জায়গাটি ভালো। বিশাল দেশ ঘুরে বেড়ানোর চমৎকার সুযোগ। এরকম পাওয়া চায় না। তাছাড়া…।
তা ছাড়া কি?
সাব্বির কথা শেষ করলো না। মাঠের দিকে চোখ ফিরিয়ে বললো—এগুলি সর্ষে ফুল না? হলুদ রঙের কি চমৎকার ভেরিয়েসন।
আমার আছে জল – ০৫ম পরিচ্ছেদ
তারা নীলগঞ্জে ডাকবাংলোয় এসে পৌঁছলো বিকেল চারটার দিকে, তখন আলো নরম হয়ে এসেছে। শীতের উত্তরী হাওয়া বইছে।