ওসমান সাহেব ভেবে রেখেছিলেন রেহানার উপর খুব রাগ করবেন। সেটা সম্ভব হলো না। সাব্বির রয়েছে। তার সামনে সিন ক্রিয়েট করার প্রশ্নই ওঠে না। তবুও বিরক্ত স্বরে বললেন—তোমরা ছিলে কোথায়?
কাছেই। তোমার জীপ তো এখনো আসেনি। এত তাড়া কিসের?
জীপ আসবে না। নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। গরুর গাড়ী নিয়ে এসেছে।
গরুর গাড়ী?
দু’টা গরুর গাড়ী একটা মহিষের গাড়ী। তাড়াতাড়ি রওনা হওয়া দরকার। পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হবে।
রেহানা অবাক হয়ে বললেন—তিনটা গাড়ী কেন?
পাগল-ছাগলের কাণ্ড। যতগুলি পেয়েছে, নিয়ে এসেছে।
তোমার পুলিশের লোকজন কেউ আসেনি?
না।
ওসমান সাহেবের মনে হলো রেহানা মুখ টিপে হাসছে। কেউ নিতে আসেনি ব্যাপারটা দুঃখজনক। এ নিয়ে হাসবে কেন? রেহানা বললেন—তোমার খবর বোধ হয় পায়নি। পেলে আসত।
ওয়ারলেস ম্যাসেজ দিয়েছি। পাবে না মানে?
তোমাদের নীলগঞ্জ থানায় হয়তো ওয়ারলেস নেই।
প্রতিটি থানায় ওয়ারলেস সেটা আছে। কি বলছ এসব?
দিলু বললো—বাবা, আমি কিন্তু মহিষের গাড়িতে করে যাব।
ওসমান সাহেব একটা ধমক দিতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করে বের হয়েছেন ছুটির সময়টায় কোন রাগারাগি করলেন না।
কিন্তু মেজাজ ঠিক রাখা যাচ্ছে না। কেন কেউ নিতে আসবে না? থানাওয়ালাদের এত বড় স্পর্ধা থাকা ঠিক নয়।
আমার আছে জল – ০৪র্থ পরিচ্ছেদ
গাড়িতে গুছিয়ে বসতে বসতে ন’টা বেজে গেলো। প্রথম কথা হয়েছিলো একটিতে যাবে শুধু মালপত্র। অন্য দু’টির একটিতে জামিল ও সাব্বির এবং আরেকটিতে দিলুরা। কিন্তু নিশাত বললো, আমি মা, বাবুকে নিয়ে একটি গাড়িতে একা যেতে চাই।
কেন?
কোন কেন-টেন নেই। এমনি যেতে চাই।
সব সময় তুই একটা ঝামেলা করতে চেষ্টা করিস।
ঝামেলা করতে চেষ্টা করি না। কমাতে চেষ্টা করি। আমি মা একা যেতে চাই।
নিশাত শেষ পর্যন্ত অবশ্যি একা একা গাড়িতে উঠেনি। রেহানা উঠেছেন তার সঙ্গে। প্রথম গাড়িটিতে বাবা, দিলু ও বাবু। মহিষের গাড়িটিতে জামিল ও সাব্বির।
গাড়ি চলা শুরু করা মাত্রই সাব্বির মাথার নিচে একটা হ্যাণ্ড ব্যাগ দিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়লো। জামিল বললো—কি, ঘুমুচ্ছেন নাকি?
হ্যাঁ। রাতে ভাল ঘুম হয়নি।
এই ঝাঁকুনিতে ঘুম হবে?
হবে। আমার অভ্যেস আছে।
ঘুমুবার আগে একটা সিগারেট খাবেন?
জ্বি না, আমি সিগারেট খাই না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সাব্বির ঘুমিয়ে পড়লো। জামিল একটা সূক্ষ্ম ঈর্ষা বোধ করলো। এত সহজে কেউ অমন ঘুমিয়ে পড়তে পারে? একা বসে থাকা ক্লান্তিকর ব্যাপার। নেমে গিয়ে প্রথম গাড়িটিতে উঠা যেতে পারে। সেখানে সিগারেট খাওয়া যাবে না এই একটা ঝামেলা। তাছাড়া সঙ্গী হিসাবে ওসমান সাহেব বেশ বোরিং হবেন বলেই তার ধারণা। লোকটির রসবোধ নেই। অফিসের বাইরে যে আরো কিছু থাকতে পারে তা খুব সম্ভব তিনি জানেন না।
এক সময় জামিলের মনে হলো এখানে আসা কি সত্যি দরকার ছিলো? মানুষ বেড়াতে যায় ফূর্তি করবার জন্য। এখানেও কি সে রকম কিছু হবে? সম্ভাবনা খুব কম। জামিল গাড়োয়ানের পাশে এসে বসলো। রাস্তায় ধুলো উড়ছে। গরুর গাড়ি খুব ধীরে চলে বলে যে ধারণা আছে সেটা ঠিক নয়। বেশ দ্রুতই চলছে। গান শুনতে শুনতে যেতে পারলে হতো। কিন্তু ক্যাসেট প্লেয়ারটি নিশাতদের সঙ্গে। ওদের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে আসবে নাকি?
নিশাতের নাক ভার হয়ে আছে। মাথায় একটা ভোঁতা যন্ত্রণা। সে বললো—মা, তোমার কাছে প্যারাসিটামল আছে?
আছে। তোর জ্বর নাকি?
না সর্দি। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে।
রেহানা তার গায়ে হাত দিলেন—গা তো বেশ গরম। শুয়ে থাক।
শুয়ে থাকতে হবে না। তুমি দু’টি ট্যাবলেট দাও।
পানি তো নাই। পানির বোতল পেছনের গাড়িতে।
পানি লাগবে না। তুমি দাও।
রেহানা দু’টি ট্যাবলেট দিলেন। নিশাত একটুও মুখ বিকৃত করলো না। ট্যাবলেট দু’টি গিলে ফেললো।
শুয়ে থাক।
আমার শুয়ে থাকার যখন প্রয়োজন হবে আমি শুয়ে থাকব। তোমার বলতে হবে না।
তুমি এত রেগে আছিস কেন?
নিশাত মায়ের চোখে চোখ রেখে শীতল গলায় বললো—সাব্বির সাহেব আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে কেন? ঠিক করে বল তো মা।
বেড়াতে যাচ্ছে, আবার কেন? ও বাংলাদেশের অনেক ছবি তুলে নিতে চায়। আমরা গ্রামের দিকে যাচ্ছি শুনে সেও আগ্রহ করে যেতে চাইলো।
না, সে কোন আগ্রহ দেখায়নি। তুমি ঝুলাঝুলি করছিলে।
যদি করেই থাকি তাতে অসুবিধা কি? আমাদের আত্মীয়, এতদিন পর দেশে এসেছে। ঘুরে-ফিরে দেখতে চায়।
আসল ব্যাপার কিন্তু তা নয় মা।
আসল ব্যাপারটা কি শুনি?
তুমি চাচ্ছ ঐ ছেলেটি যাতে আমাকে পছন্দ করে ফেলে। এবং পুরানো দুঃখ-কষ্ট ভুলে আমি তাকে বিয়ে করে ফেলি।
যদি চেয়েই থাকি সেটা কি খুব অন্যায়?
হ্যাঁ অন্যায়। তুমি যা ভাবছ সেটা ঠিক নয়।
আমি কি ভাবছি?
তুমি ভাবছ আমার স্বামী নেই। একটা বাচ্চা আছে, কাজেই আমার একটা অবলম্বন দরকার। এটা মা ঠিক না। আমি তোমাদের বিরক্ত করব না, আমি নিজের দায়িত্ব নিজে নেব। অনেকবার তো তোমাদের বলেছি।
নিশাত দেখলো জামিল এগিয়ে আসছে। সে চুপ করে গেলো।
ক্যাসেট প্লেয়ারটা তোমাদের কাছে?
জ্বি না, দিলুর কাছে।
জামিল এগিয়ে গেলো। সামনের গাড়িটি অনেক দূর চলে গেছে। নিশাত দেখলো জামিল দৌড়াতে শুরু করেছে। এই দৃশ্যটি তার কেন জানি ভালো লাগলো। রেহানা বললেন—জামিলকে বলে দে পানির বোতলটা নিয়ে যাক।