না আমার বোন।
দিলু দেখলো দু’টি লোকই গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকে দেখছে। তার বড় অস্বস্তি লাগতে লাগলো। জামিল ভাই এই বেঞ্চে বসেই চা খাবেন নাকি? লোক দু’টির কৌতূহলের সীমা নেই। একজন বললো—সাব আপনের নাম?
আমার নাম জামিল
আপনে করেন কি?
মাস্টারি করি ভাই। দেখি, একটু বসার জায়গা দেন।
দিলু অবাক হয়ে দেখলো ওরা সবাই বেঞ্চি ছেড়ে দিয়ে মাটিতে বসলো। আগের মতই তাকিয়ে রইলো অবাক হয়ে। এতটুকু সংকোচ নেই। জামিল বললো—দেখি, দু’কাপ চা দাও তো। দিলু খাবি তো?
খাব।
লোক দু’জনের একজন বললো—বজলু, সাবরে আর মাইয়াডারে কুকি বিসকুট দে। খালি পেডে চা খাওন ঠিক না। ছেলেটি দু’টি লম্বা বিসকিট হাতে করে এগিয়ে দিলো। দিলু নিলো না কিন্তু জামিল নিলো এবং চায়ে ভিজিয়ে বাচ্চাদের মত খেতে লাগলো। কি যে সব কাণ্ড জামিল ভাইয়ের। দেখতে বড় মজা লাগে।
আমার আছে জল – ০৩য় পরিচ্ছেদ
রেহানা বাবুকে নিয়ে অনেক দূর চলে গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলো সাব্বির। সাব্বির তাঁর দূর-সম্পর্কের ভাগ্নে। সাব্বিরে এখানে আসার কথা ছিলো না। হঠাৎ করেই এসেছে। এই হঠাৎ করে আসার অন্য কোন অর্থ আছে কিনা রেহানা তা বুঝতে চেষ্টা করছে। কিন্তু সাব্বির ছেলেটি হয় খুব চাপা কিংবা অতিরিক্ত চালাক। তার হাবভাব কিছুই বোঝার উপায় নেই।
রেহানার ধারণা ছিল ট্রেনে সাব্বির নিশাতের আশেপাশে বসতে চেষ্টা করবে। এবং গল্পটল্প করবে। সে তেমন কিছু করেনি। বসেছে কোণার দিকে। কিছুক্ষণ অত্যন্ত মন দিয়ে কমিক পড়েছে। ত্রিশ-বত্রিশ বৎসর বয়সের একজন মানুষ মুগ্ধ হয়ে কমিক পড়ছে, ব্যাপারটা তার ভালো লাগেনি। কমিক শেষ হওয়া মাত্র সে জানালায় হেলান দিয়ে ঘুমুতে চেষ্টা করেছে কিংবা ঘুমিয়ে পড়েছে। নিশাতের দিকে তার কোন রকম আগ্রহ বোঝা যায়নি। তবে এও হতে পারে যে, সে চেষ্টা করে তার আগ্রহ গোপন রাখছে। নিশাতকে তার ভাল রকম জানতে চায়।
আজ ভোরে তিনি দেখলেন সাব্বির ক্যামেরা হাতে একা একা যাচ্ছে। বাবুকে সঙ্গে নিয়ে তিনি নিজেও এগুলেন। অল্প কিছু কথাবার্তা হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন—দেশে কতদিন থাকবে?
বেশী দিন না। খৃসমাসের ছুটির পর যাব। জানুয়ারির তিন-চার তারিখের মধ্যে পৌঁছতে হবে।
তাহলে তো খুব অল্প দিন।
জ্বি।
রেহানা ইতস্ততঃ করে বলেই ফেললেন—বিয়ে করে বিয় নিয়ে ফিরবে নাকি? অনেকে তো তাই করে।
এখনো কিছু ঠিক করিনি। আমার মা অবশ্যি মেয়ে-টেয়ে দেখছেন। বিয়ে করতেও পারি।
রেহানা কিছু বললেন না। দেখলেন সাব্বির ক্রমাগত ছবি তুলছে। গাছের ছবি। নদীর ছবি। নৌকার ছবি। কুয়াশায় সব ঝাপসা দেখাচ্ছে। ভাল ছবি আসার কথা নয়। তবু ছবি তুলছে। রেহানা একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলেন—এই ছেলেটি অত যে ছবি তুলছে, একবারও বলেনি—আসুন মামী, আপনার একটা ছবি তুলে দেই। এই বয়সে ছবি তোলার তাঁর কোন শখ নেই। তবুও এটা সাধারণ ভদ্রতা। সাব্বির বললো—আপনার নাতি খুব শান্ত। খুব চুপচাপ।
খুব শান্ত না। বিরক্ত করে। নতুন জায়গা দেখে চুপ করে আছে। অপরিচিত মানুষের সামনে সে ভেজা বেড়াল।
ওর বয়স কত?
পাঁচ বছরে পড়লো।
রেহানা আশা করেছিলেন সাব্বির এবার বাবুর সম্পর্কে কিছু বলবে। কিন্তু সে কিছুই বললো না। অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে একটা বকের ছবি ফোকাসে আনতে চেষ্টা করলো। টেলিস্কোপিক লেন্স থাকা সত্ত্বেও বকের ছবিটি স্পষ্ট হচ্ছে না। বেশ কুয়াশা। মোটামুটি স্পষ্ট হলে ছবিটি ভালো হতো। বকের ধ্যানী ছবিটি হালকা সবুজের ব্যাকগ্রাউণ্ডে ভালো আসছে। রোদ আরেকটু চড়ে গেলে ছবি ভালো হবে না।
সাব্বির, চল যাই। তোমার মামা বোধ হয় রেগে যাচ্ছেন।
চলুন।
বাবুকে কোলে নিয়ে হাঁটতে তার কষ্ট হচ্ছে। একবার বললেন—বাবু, আমার হাত ধরে হেঁটে হেঁটে চলো। বাবু শক্ত করে তাঁর গলা চেপে ধরলো। তার মানে সে কিছুতেই নামবে না। রেহানা আশা করেছিলেন সাব্বির বললে—আমার কোলে দিন। আমি নিয়ে যাব। কিন্তু সাব্বির সে সব কিছুই বললো না। লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে লাগলো। মেয়েদের সঙ্গে এত দ্রুত হাঁটা যায় না। এই সাধারণ ভদ্রতাজ্ঞানও কি ওর নেই? রেহানা মনে মনে বেশ বিরক্ত হলেন।
স্টেশনের কাছে এসে তিনি দিলু এবং জামিলকে দেখলেন। নোংরা একটি বেঞ্চিতে বসে চা খাচ্ছে। তাদেরকে ঘিরে চার-পাঁচ জন গ্রামের মানুষ বসে আছে মাটিতে। দিলু স্কার্ট পরে থাকায় তার ফর্সা পা অনেকখানি দেখা যাচ্ছে। দৃশ্যটি তার ভালো লাগলো না। গ্রামের মানুষগুলি বোধ করি বসে আছে ফর্সা পা দেখার জন্য। তিনি একবার ভাবলেন দিলুকে ডাকবেন। কিন্তু সেটা বোধ হয় ঠিক হবে না। দিলুর জামা-কাপড় কি কি এনেছেন সেটা ভাবতে চেষ্টা করলেন। মনে পড়লো না। জামা-কাপড় সব গুছিয়েছে নিশাত, তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
দিলু তাদের দেখেই ডাকলো—মা, কোথায় ছিলে তোমরা? তারপর ছুটে এলো তাদের দিকে।
আমরা ভাবলাম তোমরা বোধ হয় হারিয়েই গেছো।
হারিয়ে যাবো কেন? নে বাবুকে কোলে নে।
দিলু বাবুকে কোলে নিয়েই বললো—সাব্বির ভাই, আমাদের একটা ছবি তুলে দিনতো। এই বাবু, উনার দিকে তাকিয়ে হাসতো লক্ষ্মী ছেলের মত। সাব্বির ক্যামেরা ঠিকঠাক করতে লাগলো। এবং ছবি তুললো বেশ কয়েকটি। রেহানার মনে হলো এই একটি ব্যাপারে ছেলেটির আগ্রহ আছে। ছবি তোলায় তার কোন ক্লান্তি নেই।