নিশাত হাসতে চেষ্টা করলো।
গল্প উপন্যাসের মত সত্যি সত্যি একদিন স্কুলে যাবার নাম করে চলে গেলাম কমলাপুর রেল স্টেশন।
তোমরা যাও নি নিশ্চয়ই?
না জামিল ভাই আসেন নি।
ভালোই করেছ যাওনি।
না ভাল করিনি। এখন তার জন্যে মনে একটা কষ্ট আছে আমার।
দিলু ছোট্ট করে বললো—তুমি কি জামিল ভাইকে বিয়ে করতে চাও?
নিশাত জবাব দিলো না। দিলু দ্বিতীয়বার বললো—তুমি কি জামিল ভাইকে বিয়ে করতে চাও?
হ্যাঁ। মনে হচ্ছে চাই।
দিলুর মনে হলো নিশাত কাঁদছে। গলার স্বর যেন ভাঙা ভাঙা। নিশাত খুব শক্ত মেয়ে। সে কি সত্যি সত্যি কাঁদবে? বিশ্বাস হয় না। দিলু মৃদুস্বরে বললো—জামিল ভাইকে কিছু বলেছ?
না
বল তাকে। তিনি তোমার জন্যেই আসেন।
নিশাত দিলুকে বুঝতে চেষ্টা করলো। শান্ত ভাবলেশহীন মুখ। লজ্জুল চোখ। বড় মায়াবতী চেহারা দিলুর।
নিশাতের মনে হলো আজ ঠিক এই মুহূর্তে দিলুর বয়স অনেকখানি বেড়ে গেছে।
লেবু ফুল ফুটছে কোথাও, মিষ্টি গন্ধ আসছে। গাঢ় অন্ধকার চারদিকে। নিশাত ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো—বেঁচে থাকা বড় কষ্ট।
আপা, চল যাই। শীত লাগছে।
আরেকটু বস? প্লীজ।
তারা দু’জন বসে রইলো প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত। এক সময় হাতে টর্চ নিয়ে তাদের খুঁজতে এলো জামিল—পানিতে ডুবে গেছো কিনা তাই দেখতে এলাম। মনে হচ্ছে ঠিক মতই আছ। কাজেই ডিস্টার্ব না করে চলে যাচ্ছি। শুধু একটা জিনিস তোমরা মনে রাখবে এ বাড়িতে ভূত আছে। ঠাট্টা না সত্যি।
নিশাত কিছু বললো না। দিলু বললো—জামিল ভাই, আপনি বসুন এখানে। আপা কি যেন বলবেন আপনাকে। টর্চটা দিন। আমি চলে যাই।
যেতে পারবে একা?
পারব।
দিলু যেতে যেতে থমকে পিছনে ফিরে তাকালো। অন্ধকারে জামিল ভাইয়ের জ্বলন্ত সিগারেট উঠানামা করছে। এর বাইরে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। কত কাছাকাছি বসে তারা দু’জন। নিশাত আপা যদি আজ বলে—জামিল ভাই চলুন আজ সারারাত আমরা গল্প করি তাহলে জামিল ভাই কি বলবেন?
রাত অনেক হয়েছে। ওসমান সাহেবের ঝিমুনি ধরে গেছে। তিনি উঠবো করছিলেন কিন্তু আবার ঠিক উঠতেও চাচ্ছিলেন না।
দিলু একসময় এসে দাঁড়ালো তার পাশে।
ঘুমোসনি মা?
না বাবা।
কোথায় ছিলি?
পুকুর ঘাটে বসেছিলাম আপার সঙ্গে। বাবা, আমি তোমার পাশে একটু বসি?
ওসমান সাহেব হাত বাড়িয়ে পাশের চেয়ারটি টানতে গেলেন। দিলু বললো—বাবা, আমি তোমার সঙ্গে বসবো। আমাকে একটু জায়গা দাও। ওসমান সাহেব সরে জায়গা করে দিলেন। নরোম স্বরে বললেন, দিলু তোর কি হয়েছে?
বাবা, আমার বড় কষ্ট!
কিসের কষ্ট?
জানি না বাবা।
ওসমান সাহেব মেয়েকে জড়িয়ে ধরে তাঁর মনে হলো দিলু কাঁদছে। কিন্তু দিলু কাঁদছিলো না।
ওসমান সাহেব ভরাট গলায় বললেন—যাও মা ঘুমুতে যাও। ঠাণ্ডা হওয়া দিচ্ছে শরীর খারাপ করবে।
রেহানা বাবুকে ঘুম পাড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে শুয়েছিলেন। দিলুকে দেখে বললেন—তোর কি শরীর খারাপ? তোকে এমন লাগছে কেন?
শরীর ভালই আছে।
নিশাত কোথায়?
পুকুর ঘাটে।
রেহানা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন-এত রাতে একা একা সেখানে কি করছে?
একা একা না মা। জামিল ভাই আছেন।
রেহানা উঠে বসলেন। তাঁর ধারণা ছিলো জামিলকে নিশাত সহ্য করতে পারে না। তিনি কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও জিজ্ঞেস করলেন না। দিলু বললো—মা আমি তোমার পাশে একটু শুয়ে থাকি?
দিলু মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো। ফিস ফিস করে বললো—নিশাত আপার সঙ্গে জামিল ভাইয়ের বিয়ে হলে ভালই হবে মা।
কি বলছিস বিড়বিড় করে। পরিষ্কার করে বল।
কিছু বলছি না মা।
দিলু আরো শক্ত করে মাকে জড়িয়ে ধরলো। চারিদিকে আবছা অন্ধকার। ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে। শীতের হিমেল হাওয়া। বাবু ঘুমের মধ্যেই কেঁদে উঠলো। একটা টিকটিকি ডাকলো—টিক টিক টিক।
আমার আছে জল – ১২শ পরিচ্ছেদ
দিলু ভাসছিল মাঝপুকুরে।
তার পরনে লাল একটা স্কার্ট। মাথার কালো চুল চারদিকে ছড়ানো। দীঘির সবুজ জলের ব্যাকগ্রাউণ্ডে একটি অসাধারণ কম্পোজিশন। একজন ফটোগ্রাফার এরকম একটি দৃশ্যের জন্যে সারা জীবন অপেক্ষা করে।
সাব্বির দীর্ঘ সময় দিলুর ভেসে থাকা শরীরটির দিকে তাকিয়ে রইলো। ভোরের আলো ফুটে উঠতে শুরু করেছে। স্কার্টের রঙ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। সাব্বির ছবি তুলতে গিয়েও তুলতে পারলো না। পাগলের মতো চেঁচাতে লাগলো—তোমরা কে কোথায় আছ এই মেয়েটিকে বাঁচাও।
দমকা একটা হাওয়া এল তখন। সে হাওয়ায় দিলু ভেসে আসতে লাগলো ঘাটের দিকে। যেন সে বলছে—“ছবি তুলুন সাব্বির ভাই।”
(সমাপ্ত)