গল্প শুনে হাসতে হাসতে রেহানা বিষম খেলেন এবং মনে মনে স্বীকার করলেন ছেলেটি রসিক। প্রচুর রসজ্ঞান না থাকলে গল্পটি এত সুন্দরভাবে বলা সম্ভব নয়। ওসমান সাহেব বললেন—সবাই একটা না একটা গল্প করছে। নিশাত চুপ করে আছে কেন?
বাবা আমি শুনছি।
শুধু শুনলে হবে না। বলতেও হবে।
নিশাত মৃদুস্বরে বললো—একটা মজার জিনিস লক্ষ্য করলাম আমি। জামিল ভাই হঠাৎ করে দিলুকে তুমি তুমি করে বলছেন।
জামিল শান্ত স্বরে বললো—দিলু বড় হচ্ছে এখন আর ওকে তুই বলা ঠিক নয়।
বড় কোথায়, ওর বয়স চৌদ্দ বছর মাত্র।
দিলু শীতল কণ্ঠে বললো—নভেম্বরে আমার পনেরো হয়েছে আপা। তোমার কিছু মনে থাকে না।
পনেরো হলেই যদি তুমি বলতে হয় তাহলে তো আমাদেরকেও তুমি বলতে হয়।
দিলু কিছু বললো না। ওসমান সাহেব বললেন—দিলু মা’র মনটা মনে হয় খারাপ। নিশাত বললো ওর মন ভালোই আছে। লোকজন ওকে তুমি করে বলা শুরু করেছে। মন খারাপ হবে কেন?
আমার মন ভালোই আছে।
সাব্বির বললো—মন ভালো থাকলে আমাদের একটা হাসির গল্প শুনাতে হবে। দিলু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে গল্প শুরু করলো—পরীক্ষায় গরু সম্পর্কে রচনা এসেছে। সবাই লিখছে। একটি ছেলে বললো—স্যার জহির নকল করছে। স্কুলের মাঠে একটা গরু বাঁধা আছে। জহির জানালা দিয়ে গরুটা দেখছে আর লিখছে। ওসমান সাহেব ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলেন। মদ্যপানজনিত কারণে তিনি ইষৎ তরল অবস্থায় আছেন। ছোট ছোট হাসির ব্যাপারগুলো তাঁর কাছে অসাধারণ মনে হলো।
আরেকটা বলতো মা দিলু।
ইতিহাসের স্যার প্রশ্ন করলেন—আচ্ছা বলতো শেরশাহ কোথায় মারা গেছেন? ছাত্র বললো—ইতিহাস বইতে স্যার। পনেরো পাতায়।
রেহানার মনে হলো তার এই মেয়েটি একটু অন্যরকম হয়েছে। কারো সঙ্গেই ঠিক মেলে না। একটু যেন আলাদা। নিশাত বললো, দু’টি গল্পই জামিল ভাইয়ের কাছ থেকে শোনা তাই না?
হ্যাঁ। তাতে কোন অসুবিধা আছে?
দিলু একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে যেন সে সত্যি জবাবটি শুনতে চায়। সাব্বির বললো—এক কাপ চা খেতে পারলে মন্দ হতো না। কেউ কি কষ্ট করে চা বানাবে?
নিশাত উঠে দাঁড়ালো—আমি বানাবো। দিলু, তুই আয়তো আমার সঙ্গে, একা একা ভয় লাগে।
কেটলিতে চায়ের পানি ফুটছে। নিশাত এবং দিলু বসে আছে চুপ-চাপ। দিলুর মুখ থমথম করছে। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে কিছুক্ষণের মধ্যে কাঁদবে। নিশাত বললো—তুই চা খাবি নাকি দিলু?
না।
আয় আমরা বরং কফি খাই। ইনসটেণ্ট কফির পটটা কোথায় দেখেছিস?
আপা, আমি কফি খাব না। তুমি কি বলবে বল।
আমি আবার কি বলব?
কিছু একটা বলবার জন্যেই আমাকে রান্নাঘরে এনেছ। এখন বল কি বলবে।
দিলু, তুই কি রাগ করেছিস?
দিলু চুপ করে রইলো।
নিশাত বললো, চল দু’জনে দু’কাপ চা নিয়ে পুকুর ঘাটে বসি। যা, গরম চাদর একটা গায়ে জড়িয়ে আয়।
তুমি কি ওখানে নিয়ে আমাকে কিছু বলতে চাও?
আয় না গিয়ে বসি, তারপর বলা যাবে। যা চাদর-টাদর কিছু একটা গায়ে দিয়ে আয়।
দিলু উঠে গেলো। লাল রঙের একটা শাল বের করে গায়ে দিলো। কাঁচঘরের পাশে জামিল সিগারেট টানছে। সে উঁচু গলায় বললো—কোথায় যাচ্ছিস রে?
দিলু জবাব দিলো না। জামিল ভাই তুই বললে সে আর জবাব দেবে না। জামিল বললো—দিলু কোথায় যাচ্ছ?
পুকুর ঘাটে।
একা একা? একটু সাবধানে থাকবে।
কেন?
ভূত আছে।
আপনার মাথা আছে।
জামিল শব্দ করে হাসলো—তুমি চাইলে আমি সাহস দেবার জন্যে সঙ্গে থাকতে পারি।
সাহস দিতে হবে না।
পুকুর ঘাটটি বড় বেশী নির্জন। মাঝে মাঝে হাওয়া আসে, গাছের পাতায় সরসর শব্দ হয়। ক্রমাগত ঝিঁঝিঁ ডাকে আবার কোন এক বিচিত্র কারণে হঠাৎ ঝিঁঝিঁর ডাক বন্ধ হয়ে চারদিকে সুনশান নীরবতা নেমে আসে। নিশাত বললো—একটু যেন ভয় ভয় লাগেরে।
ফিরে যাবে?
নাহ্, বস।
তারা বসলো। নিশাত ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললো। দিলু বললো—আপা, তুমি কি বলতে চাও বল। নিশাত চাপা স্বরে বললো—আমার যখন তোর মত বয়স তখন জামিল ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। জামিল ভাইরা তখন আমাদের পাশের বাসায় থাকতেন। মগবাজারে।
আপ, আমি জানি।
না, সবটা তুই জানিস না। তারপর কি হলো শোন। চৌদ্দ-পনেরো বছর বয়সটাতো খুব খারাপ। সেই বয়সে কাউকে ভালো লাগলে সেটা যে কত তীব্র হয় তা তুই বুঝতে পারছিস কিছুটা। পারছিস না?
দিলু তাকিয়ে রইলো, কিছু বললো না। নিশাত বললো—অল্প বয়সের ভাল লাগার অনেক রকম ব্যাপার আছে। যখন কলেজে উঠলাম তখন লক্ষ্য করলাম জামিল ভাইকে আর ভালো লাগছে না। এরকম হয়। বি. এ. পড়বার সময় বিয়ে হয়ে গেলো। যার সঙ্গে বিয়ে হলো সে জামিল ভাইয়ের ছোটবেলার বন্ধু।
এসব তো আপা আমি জানি।
সবটা জানিস না। শোন মন দিয়ে। তোর দুলাভাই একজন চমৎকার মানুষ ছিলেন। পৃথিবীর যে কোন মেয়ে তাকে বিয়ে করে সুখী হতে পারতো। কিন্তু আমি হইনি। আমার সারাক্ষণই জামিল ভাইয়ের কথা মনে হতো।
নিশাত চোখ মুছলো। দিলু বললো—আমাকে এসব শুনাচ্ছ কেন আপা?
জানি না কেন।
আমার এসব শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
নিশাত চুপ করে রইলো। কাছেই কোথাও সরসর শব্দ হচ্ছে।
দিলু বললো—চলো আপা ঘরে যাই।
আরেকটু বস। তোকে একটা মজার গল্প বলি। ক্লাস টেনে উঠলাম যেবার সেবার আমি আর জামিল ভাই মিলে ঠিক করলাম পালিয়ে যাব।
কোথায় পালিয়ে যাবে?
সে সব কিছু ঠিক হয়নি। ঐ বয়সে ভেবে চিনতে তো কিছু কখনো করা হয় না। ভেবে চিনতে কাজ করতে পারলে এত ঝামেলা হয়?