না আপনি বিশ্রাম করুন।
রেহানা চলে গেলেন। পুরুষ মানুষ রান্নাঘরে হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে নাড়াচাড়া করছে এটা তাঁর দেখতে ভালো লাগে না। অসহ্য লাগে। রেহানা বারান্দায় থমকে দাঁড়ালেন। নিচু গলায় বললেন—আজও বসেছ?
হ্যাঁ বসলাম।
বোতল ক’টা এনেছ?
বেশী না, দু’টো মাত্র। রেহানা, একটু বস আমার পাশে।
না।
কেন এরকম করছ? বেশীদিন তো আর বাঁচবো না। শেষ ক’টা দিন আরাম করতে দাও।
বেশীদিন বাঁচবে না এই তথ্যটা আবার কবে জোগাড় করলে?
এক পামিস্ট আমার হাত দেখে বলেছে আমি বাঁচব মাত্র ষাট বছর। ভাল পামিস্ট। যা বলে তাই ঠিক হয়। একটু বস রেহানা।
রেহানা বসলেন। ওসমান সাহেব হৃষ্ট গলায় বললেন—একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করি, দেখি বলতে পার কিনা।
ধাঁধা জিজ্ঞেস করতে হবে না। বসে থাক চুপচাপ।
দারুণ ধাঁধা, দিলুর কাছ থেকে শিখেছি এবং নিজে নিজেই উত্তর বের করেছি। আমি এক হাজার টাকা বাজি রাখছি তুমি পারবে না। কি, বলব?
ওসমান সাহেব দিলুর পানি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেওয়ার ধাঁধাটি খুব উৎসাহের সঙ্গে বলতে শুরু করলেন।
কাঁচঘরের পাশের ফাঁকা জায়গাটায় হাঁস ঝলসানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাতাসের জন্য আগুন তেমন জ্বলছে না। বাঁশের চাটাই দিয়ে হাওয়া আটকানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। জামিল তদারক করছে মোডায় বসে। দিলু বারান্দা থেকে তাদের দেখলো। একবার ভাবলো কাছে যাবে। কিন্তু গেলো না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো। জামিল ডাকলো—এই দিলু এদিকে আয়। দিলু এগিয়ে গেলো।
আমাদের ফটোগ্রাফার সাহেব কি হাঁসকে বাতাস দিয়ে শেষ করেছেন? দিলু জবাব দিলো না।
কি ব্যাপার এত গম্ভীর কেন?
মাথা ধরছে।
আগুনের পাশে বস। মাথা ধরা সেরে যাবে। চেয়ারটা টেনে আন।
দিলু বসলো।
গল্প শুনবি নাকি বল? মারাত্মক একটা ভূতের গল্প জানি। বলব?
না।
না কেন? তোর কি হয়েছে?
দিলু মৃদুস্বরে বললো—জামিল ভাই, আপনি আমাকে দুই করে বলবেন না।
কেন? বলব না কেন?
আমার খারাপ লাগে।
আপনি করে বলব। তাই চাস?
দিলু জবাব দিলো না।
তোর কি হয়েছে?
দিলু গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়ালো। জামিল তাকে হাত ধরে টেনে বসালো।
দিলু, তোমার কি হয়েছে?
কিছু হয়নি।
না কিছু একটা হয়েছে। আমাকে বল।
আমার খুব মন খারাপ লাগছে। মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।
দূর বোকা মেয়ে।
জামিল শব্দ করে হাসলো। একটা হাত রাখলো দিলুর পিঠে। নিশাত দূর থেকে দৃশ্যটি দেখলো। একবার ভাবলো—দিলুকে সে ডাকবে। কিন্তু ডাকলো না। আগুনের পাশে বসে থাকা মানুষ দু’টিকে সুন্দর লাগছে। বাবু জেগে উঠে কাঁদছে। রেহানা এসে বললেন—বাবুকে একটু পাড়িয়ে দেনা নিশাত।
আমি পারব না।
দাঁড়িয়েই তো আছিস।
দাঁড়িয়ে আছি না মা। দেখছি।
কি দেখছিস?
দিলুকে দেখছি। দিলু কেমন বড় হয়ে যাচ্ছে দেখেছো মা?
রেহানা তাকালেন। তিনি দিলুর বড় হয়ে যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখলেন না। দিলু চেয়ারে বসে পা নাচাচ্ছে। এটা একটা অভদ্রতা, দিলুকে বলতে হবে। তিনি বাবুর কাছে গেলেন। নিশাত চড়া গলায় বললো—দিলু তুই একটু আয়।
দিলু শান্ত স্বরে বললো—না। জামিল বললো—যাও না, শুনে আস কি জন্যে ডাকছে।
না আমি যাব না।
জামিল কৌতূহলী হয়ে তাকালো। তার মনে হলো দিলু কেমন যেন বদলে যেতে শুরু করেছে।
আমার আছে জল – ১১শ পরিচ্ছেদ
রোস্ট জিনিসটি যে খেতে এত ভাল হবে রেহানা কল্পনাও করতে পারেননি। তাঁর আফসোস হতে লাগলো তিনি পাশে বসে রান্নার পুরো ব্যাপারটা কেন দেখলেন না। সাব্বির বললো—আমি খুব গুছিয়ে লিখে রেখে যাব আপনার যখন ইচ্ছা রান্না করতে পারবেন।
বালি হাঁস ছাড়া সাধারণ হাঁস দিয়ে রান্না হবে?
জানি না। হওয়া তো উচিত। আমি অবশ্যি কখনো ট্রাই করিনি।
জামিল বললো, আমার মনে হয় না সাধারণ হাঁস দিয়ে এটা হবে। সাধারণ হাঁসগুলোর গায়ে প্রচুর চর্বি থাকে। বালি হাঁসের গায়ে চর্বি থাকে না।
নিশাত হাসিমুখে বললো—আপনি বুঝি পৃথিবীর সব জিনিস জানেন?
না, আমি খুব কমই জানি, মাঝে মাঝে লজিক খাটিয়ে দু’একটা কথা বলতে গিয়ে সবাইকে বিরক্ত করি।
ওসমান সাহেব বললেন—দিলুকে দেখছি না যে। দিলু কোথায়?
ও খাবে না। ওর মাথা ধরেছে।
চেখে দেখুক। ডেকে নিয়ে আয়তো নিশাত।
অনেক বলেছি বাবা।
জামিল বললো—আমি নিয়ে আসছি।
দিলু কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়েছিলো। জামিলকে ঢুকতে দেখে উঠে বসলো। ঘর অন্ধকার। আলো চোখে লাগে বলে হ্যারিকেন ডিম করে রাখা হয়েছে। জামিল বললো—দিলু আমাদের সঙ্গে এসে বস। জিনিসটা বেশ ভাল হয়েছে। তোমার ভাল লাগবে। দিলু জবাব দিলো না।
তুমি হয়তো লক্ষ্য করনি। আমি তুমি করে বলছি। এসো দিলু। খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা অনেক রাত পর্যন্ত আগুনের পাশে বসে গল্প করব।
আমার মাথা ধরেছে জামিল ভাই।
এমন মজার গল্প বলব যে মাথা ধরা সেরে যাবে। এসো!
দিলু উঠে এলো। গল্প খুব জমে উঠলো খাবার টেবিলে। ওসমান সাহেব পর্যন্ত একটা হাসির গল্প বলে ফেললেন। নাসিরুদ্দিন হোজ্জার গল্প। সবারই জানা তবু সবাই হাসলো। কিছু কিছু সময় আসে যখন সব কিছুই ভালো লাগে।
সাব্বির বললো নিউইয়র্কে এক হোটেলে তার অভিজ্ঞতার গল্প—তার বিছানার সঙ্গে একটা যন্ত্র ফিট করা। সেখানে লেখা গা ম্যাসাজ করতে হলে এখানে দু’টি কোয়ার্টার ফেলুন। বেচারা সরল মনে দু’টি কোয়ার্টার ফেললো। তারপর বিছানায় শোয়ামাত্র বিছানা কাঁপতে শুরু করলো। সে কি কাঁপুনি। বসে থাকা যায় না, ছুঁড়ে ফেলে দিতে চায়। মিনিট দশেক পর কাঁপুনি থামলো। কিন্তু যন্ত্রটির বোধ হয় কিছু একটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো, কিছুক্ষণ পর আবার শুরু হলো কাঁপুনি। থামে, আবার শুরু হয়। আমার থামে আবার শুরু হয়।