ওসমান সাহেব সত্যিকার অর্থেই ছুটির আনন্দ ভোগ করলেন। আলিম এসে পেঁয়াজ, মরিচ ও ভিনিগার মাখানো এক প্লেট চিনাবাদাম রেখে গেছে। হুইস্কির সঙ্গে এই প্রিপারেশনটি অপূর্ব।
গ্লাসে চুমুক দিয়ে তাঁর মনে হলো বেঁচে থাকাটা অত্যন্ত আনন্দের ব্যাপার। গভীর আনন্দে তাঁর শরীর কাঁপছে। হুইস্কি নিয়ে তো প্রায়ই বসেন এ রকম কখনো হয় না। আজ হচ্ছে কেন? ইচ্ছে হচ্ছে হেসে হেসে সবার সঙ্গে কিছু সময় কাটাতে। চাঁদ উঠেছে কিনা কে জানে। যদি চাঁদ উঠে তাহলে ওভারকোটটি গায়ে দিয়ে একটু হেঁটে আসলে হয়তো ভালোই লাগবে।
বারান্দার কাছে কে যেন এসে দাঁড়িয়েছে। অপরিচিত কেউ। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। তবু তিনি পরিষ্কার বুঝলেন লোকটির গায়ে ইউনিফর্ম।
খট শব্দে স্যালুট হলো—স্যার আমি। ওসি সাহেব পাঠিয়েছেন।
কি ব্যাপার?
কিছু না স্যার। পাহারার জন্য। ফিক্সড সেণ্ট্রি।
পাহারা লাগবে না তুমি চলে যাও।
সে ইতস্ততঃ করতে লাগলো। ওসমান সাহেব দরাজ গলায় বললেন—যাও যাও পাহারার কোন দরকার নেই? আমি কি মিনিষ্টার?
এই বলেই তিনি প্রচুর হাসতে লাগলেন। খালি পেটে দু’পেগ পড়ার জন্যেই বোধ হয় তাঁর কিঞ্চিত নেশা হয়েছে।
আলিমের দাঁতের ব্যথা কমেনি। আজ সারাদিন আরো বেড়েছে। ডান দিকের গাল ফুলে গেছে অনেকখানি।
আলিম গোটা চারেক প্যারাসিটামিল খাও।
স্যার খাইছি।
লবন পানি দিয়ে কুলকুচি কর।
করেছি স্যার।
গরম সেঁক দাও। সেঁকটা খুব উপকারী।
স্যার আর কিছু লাগবো?
না লাগবে না। খানা তৈরী হতে দেরী হবে নাকি?
জ্বি স্যার।
আচ্ছা ঠিক আছে।
আজ রাতে রান্নার দায়িত্ব নিয়েছে সাব্বির। ওয়াইল্ড ডাক রোস্টের সে নাকি একটা চমৎকার প্রেপারেশন জানে। দুপুর বেলাতেই সে বালি হাঁসগুলিত চামড়া তুলে টক দৈ-এ ডুবিয়ে রেখেছে। টক দৈ-এ আট ঘণ্টা ডুবানো থাকতে হবে, এক মিনিটো এদিও ওদিক হতে পারবে না।
আট ঘণ্টা পার হয়েছে রাত আটটায়। এখন হাঁসগুলোকে স্টীম করা হচ্ছে। কেটলীর পানি ফুটানো হচ্ছে। কেটলির নল দিয়ে যে বাষ্প বেরিয়ে আসছে তাই ব্যবহার করা হচ্ছে স্টীম করবার জন্যে। কায়দাটা ভালোই। দিলু সমস্ত ব্যাপারটা দেখছে মুগ্ধ হয়ে। সে রান্নাঘরে একটা চেয়ার নিয়ে চেয়ারের উপর পা তুলে আরাম করে বসে আছে। এবং সারাক্ষণই কথা বলছে।
সাব্বির ভাই স্টিম দিচ্ছেন কেন?
স্টিম দেয়ার জন্যে মাংশ নরম হবে।
টক দৈ-এ ডুবিয়া রাখলেন কেন?
রেসিপিতে বলা আছে তাই। টক দৈ না পেলে ভিনিগারেও ডুবিয়ে রাখা যেতো। টক দৈ ভিনিগারের চেয়ে ভালো।
এরপর কি করবেন?
পেটের ভেতর রসুন ভরে আগুনে ঝলসাবো। ব্যাস।
এই রান্না কার কাছ থেকে শিখলেন?
আমার এক মেক্সিকান বান্ধবী ছিলো ও রাঁধতো। ও অনেক রকম রান্না জানতো।
দিলু একটু লজ্জা পেলো। কেউ এভাবে বান্ধবীর কথা বলে নাকি? কিন্তু সাব্বির ভাই এমন সহজভাবে বলছেন যেন বান্ধবী থাকার মধ্যে লজ্জার কিছু নেই।
উনার নাম কি সাব্বির ভাই?
ওর নাম মারিয়া।
মারিয়া?
কি বিশ্রী নাম।
বিশ্রী কোথায়? মেরী থেকে মারিয়া।
উনি দেখতে কেমন?
আমার কাছে তো ভালোই লাগতো। খুব লম্বা। বড় বড় কালো চোখ। খুব শব্দ করে হাসতো।
উনার ছবি আছে?
আছে। দেখতে চাও?
হুঁ।
আচ্ছা দেখাব।
সাব্বির ভাই, আমার কয়েকটা সুন্দর ছবি তুলে দেবেন তো।
দেব।
কবে দেবেন?
যখন চাও। কাল ভোরেই দিতে পারি। এক কাজ করো। তোমার লাল শাড়ি আছে?
না, লাল স্কার্ট আছে।
ঠিক আছে ঐ লাল স্কার্ট পরে পুকুরে সাঁতার দেবে। আমি ছবি তুলব। সবুজ পানির ব্যাকগ্রাউণ্ডে লাল স্কার্ট চমৎকার আসবে। তবে আমার ফিল্ম হাই স্পীড এ. এস. এ. ফাইভ হানড্রেড। আরেকটু কম হলে ভালো হতো।
আমি তো সাঁতার জানি নে।
ইস, সাঁতার দেয়া ছবি ভালো আসতো। জলকন্যার এফেক্ট পাওয়া যেতো।
রাত-দিন আপনি শুধু ছবির কথা ভাবেন। তাই না?
হুঁ ভাবি।
দিলু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। দেখলো সাব্বির কিভাবে হাঁসের গায়ে স্টীম লাগাচ্ছে। দেখে মনে হয় লোকটা এ কাজ দীর্ঘদিন ধরে করছে। দিলু বললো—মারিয়া বুঝি খুব ভালো মহিলা ছিলেন?
হ্যাঁ। বাঙ্গালী মেয়েদের মতো।
বাঙ্গালী মেয়েরা বুঝি ভালো?
হ্যাঁ। বাঙ্গালী মেয়েরা খুব সেণ্টিমেণ্টাল। সেণ্টিমেণ্টাল না হলে মেয়েদের মানায় না।
আচ্ছা, সাব্বির ভাই, আমি কি সেণ্টিমেণ্টাল?
হ্যাঁ।
কিভাবে বুঝলেন?
জামিল সাহেবের সঙ্গে বসে তুমি গল্প করছিলে, আমি শুনছিলাম।
কথা শুনেই বুঝে গেলেন?
দিলু, কথা শুনে অনেক কিছুই বোঝা যায়। আমি বুঝতে পারি।
দিলু ভয়ে ভয়ে বললো—আর কি বুঝেছেন?
বুঝলাম যে, তুমি জামিল সাহেবের প্রেমে পড়েছেও। এডোলেসেন্স লাভ। চমৎকার জিনিস।
দিলুর কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগলো। মিনিট পাঁচেক কোন কথাবার্তা না বলে সে চুপচাপ বসে রইলো। সাবির হাসিমুখে বললো—কি দিলু, ঠিক বলিনি?
দিলু কোন জবাব দিলো না।
রেহানা রান্নাঘরে ঢুকে দেখলেন চোখমুখ লাল করে দিলু চেয়ারে পা উঠিয়ে বসে আছে। তিনি বিরক্ত স্বরে বললেন—তুই এখানে কি করছিস?
দেখছি।
বাবুকে একটু সামলাবার চেষ্টা করলেও তো পারিস। আমি কতক্ষণ দেখব?
দিলু নিঃশ্বব্দে উঠে চলে গেলো। রেহানা বললেন—সাব্বির, তোমার রান্নার কতদূর?
হয়ে এসেছে। এখন শুধু আগুনে ঝলসাব।
খাওয়া যাবে তো?
আপনাদের ভাল লাগবে। ভাল না লাগলে এতটা কষ্ট শুধু শুধু করতাম না।
রেহানা বললেন—আমাকে কিছু করতে হবে?