না, আমি লক্ষ্য করিনি। গ্রামই দেখিনি। গ্রামের মেয়ে দেখবো কোথায়?
গ্রামের মেয়েরা যে সবুজ শাড়ি পরে এটাও কিন্তু প্রথম নোটিশ করে কবির। তার ধারণা এরা সবুজ দেখতে দেখতে সবুজ রঙের প্রতি একটা উইকনেস জন্মিয়ে ফেলে। আমার ধারণা কিন্তু তা নয়।
আপনার কি ধারণা?
আমার ধারণা সবুজ রঙের কাপড় ময়লা হয় কম, সে জন্যই এরা সবুক কাপড় পরে।
আপনার ধারণাটাই প্রাকটিক্যাল। কিন্তু হঠাৎ করে আপনি রঙের প্রসঙ্গ আনলেন কেন?
জামিল কিছু বললো না। স্পীড বোটে উঠে বসলো। স্পীড বোটের ড্রাইভার রোদের মধ্যে পা মেলে দিয়ে দিব্যি ঘুমুচ্ছে। নিশাত ফ্লাক্স খুললো—চা দেব জামিল ভাই?
দাও।
চায়ের সঙ্গে আর কিছু? কেক আছে। নষ্ট হয়ে গেছে কিনা কে জানে।
নিশাত এক পিস কেক বের করে মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিলো। সে নিলো না। পিছিয়ে গেলো অনেকখানি। জামিল বললো—এ ভিখিরী নয় কারো কাছ থকে কিছু নেয়ে এর অভ্যেস নেই।
আপনি চট করে সবকিছু বুঝে যান কিভাবে?
জামিল হাসলো। ঠিক তখনি পর পর দু’টি গুলির শব্দ হলো। ওরা পাখি পেয়েছে কিনা কে জানে। স্পীড বোটের ড্রাইভার চোখ কচলে উঠে বসলো। শিকারীরা হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবে। নিশাত অবাক হয়ে দেখলো তার মাথার উপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে যাচ্ছে। আশ্চর্য, এত পাখি! তারা ডাকছে কর্কশ গলায়। শুনতে ভালো লাগে না।
ওরা কোথায় যাবে?
নিরাপদ কোন জায়গায় যাবে। তারপর সেখানেও শিকারীরা যাবে। সেখান থেকেও এদের উড়ে যেতে হবে।
নিশাত তাকিয়ে রইলো। জামিল বললো—সমস্ত জীব-জন্তু ও পশুপাখির জীবনের বেশীর ভাগ সময় কেটে যায় নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করতে গিয়ে। মানুষের জন্যেও এটা সত্যি। আমরাও নিরাপদ আশ্রয় খুঁজি।
মাস্টারী করতে করতে বক্তৃতা দেয়া আপনার অভ্যেস হয়ে গেছে তাই না?
হ্যাঁ।
এবং আপনি মনে করেন জগৎ-সংসারের সমস্ত রহস্য আমি বুঝে ফেলেছেন?
না, তা বুঝিনি তবে বুঝতে চেষ্টা করি। তোমার মত চোখ বন্ধ করে থাকি না।
জামিল একটা সিগারেট ধরালো। নিজেই হাত বাড়িয়ে ফ্লাক্স থেকে চা ঢাললো। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছিলো সে বড়সড় একটা বক্তৃতা দেবে কিন্তু জামিল তেমন কিছুই করলো না। সিগারেট টানতে টানতে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। স্পীড বোটের ড্রাইভার নেমে গিয়ে ছোট মেয়েটির সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিয়েছে। এতক্ষণ যে মেয়ে একটি কথাও বলেনি, তার মুখে এখন খই ফুটছে।
তোর নাম কি?
ফুলি।
তোর বাপের নাম কি?
কসির শেখ।
কোন গ্রাম?
আতরা, মিয়াবাড়ি।
ভাই-ভইন কয়জন?
ছয়জন।
নিশাত খুব মন দিয়ে ওদের কথাবার্তা শুনছে। এই মেয়েটি এতক্ষণ চুপ করে ছিলো কেন?
জামিল ভাই।
বল।
এই মেয়েটি এতক্ষণ কোন কথাবার্তা বলেনি কিন্তু দেখুন ঐ লোকটির সঙ্গে কেমন জমিয়ে গল্প করছে।
জামিল কোন উত্তর দিলো না।
জামিল ভাই, আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন?
না, রাগ করিনি। রাগ করতে হলে একটা অধিকার থাকতে হয়। তোমার ওপর আমার সে রকম কোন অধিকার নেই।
দিলুর উপর আছে?
হ্যাঁ আছে। ওর সঙ্গে আমি কিন্তু প্রায়ই রাগ করি।
আপনারা কি নিয়ে এত কথা বলেন?
যা মনে আসে তাই বলি। ওর সঙ্গে তো আর হিসেব করে কথা বলতে হয় না।
নিশাত গম্ভীর ভঙ্গিতে বললো—আমার কিন্তু মনে হয় ওর সঙ্গেই আপনার সবচে সতর্ক হয়ে কথাবার্তা বলা উচিত।
কেন?
এই বয়সে মন অন্য রকম থাকে। আপনি কি বুঝতে পারছেন আমি কি বলতে চাচ্ছি?
পারছি।
আপনি কি এই প্রসঙ্গে কিছু বলতে চান?
চাই। নিজেকে দিয়ে সবাইকে বিচার করা ঠিক নয়।
তার মানে?
দিলুর মত যখন তোমার বয়স ছিলো তখন তুমি আমার প্রতি অন্যরকম ধারণা পোষণ করতে।
এসব আপনি কি বলছেন?
স্কুল ছুটির পর ক’দিন এসেছ আমাদের বাড়িতে মনে আছে?
কেন আপনি এখন এইসব পুরনো কথা তুলছেন?
জামিল চুপ করে গেলো।
দেখা গেলো শিকারীরা ফিরে আসছে। ওসি সাহেবের হাতে কয়েকটা হাঁস। ওদের জবাই করা গলা দিয়ে তখনো ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে। দিলু ওসমান সাহেবের শরীরে ভর দিয়ে পা টেনে টেনে ফাঁটছে। জামিল বললো—কি হয়েছে দিলু?
পায়ে কাঁটা ফুটেছে।
শিকার কেমন লাগলো?
ভালো না।
ওসমান সাহেব উল্লাস বোধ করছিলেন। তার চোখে-মুখে ক্লান্তির কোন চিহ্নই নেই। ওসি সাহেব বললেন—স্যার, কাল আবার যাবো নাকি?
চলেন যাই। নতুন কোন স্পটে চলেন।
স্যার, যেতে হবে কিন্তু আরো সকালে। সবচেয়ে ভাল হয় যদি শেষ রাতে উঠতে পারেন।
উঠব। শেষ রাতেই উঠবো। নো প্রবলেম।
ওসমান সাহেব নীলগঞ্জ থানার ওসি সাহেবের ওপর অত্যন্ত প্রসন্ন বোধ করেন।
ওসি সাহেব রাতে খান আমাদের সঙ্গে।
জ্বি-না স্যার। জ্বি না।
দিলু বসে নিশাতের পাশে। গাছের গুঁড়িতে বসে থাকা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে—এই, নাম কি তোমার?
ফুলি।
বাহ্ কি সুন্দর নাম! ফুল থেকে ফুলি।
ছোট্ট মেয়েটি ফিক করে হেসে ফেললো। দিলু বললো—সাব্বির ভাই থাকলে এই মেয়েটির ছবি তুলতে বলতাম। কি সুন্দর মেয়ে দেখছ আপা? নিশাত জবাব দিলো না। দিলু বললো—গ্রামের মেয়েরা কি সুন্দর হয়। বড় মায়া লাগে।
আমার আছে জল – ১০ম পরিচ্ছেদ
ওসমান সাহেব হুইস্কির বোতল নিয়ে বসেছেন। তাঁর ভাগ্য ভালো বরফের জোগাড় হয়েছে। ওসি সাহেব জীপ পাঠিয়ে বরফ আনিয়েছেন। শুধু বরফ নয় তিনি এক কেস বিয়ার এনেছেন। ওসমান সাহেব বিয়ার খান না। তবু খুশী হলেন। প্রথম দিনে এই ওসির উপর এতটা বিরক্ত হওয়া ঠিক হয়নি।