বড় গাঙের চর পর্যন্ত স্পীডবোট নিয়ে যাবার উপায় নেই। পানি কম। তাছাড়া ভট ভট শব্দ হচ্ছে। শব্দে পাখি উড়ে যাবে। ওসি সাহেব বললেন—এখান থেকে যেতে হবে পায়ে হেঁটে। অসুবিধা হবে নাতো স্যার?
না অসুবিধা কি?
খানিকটা পানি ভেঙে যেতে হবে।
বেশী পানি?
জ্বি না স্যার। খুব বেশী হলে হাঁটুপানি। জুতো খুলে ফেলেন। ওসমান সাহেব জুতা খুলে ফেললেন। দিলুও জুতা খুললো। ওসি সাহেব অবাক হয়ে বললেন—তুমিও যাবে নাকি খুকি?
জ্বি।
কষ্ট হবে। একটু পরেই রোদ উঠবে কড়া।
উঠুক।
ওসমান সাহেব বললেন—শখ করে এসেছে, চলুক। নিশাত, তুই যাবি নাকি?
আমি হাঁটু পানি ভেঙে যাব? পাগল হয়েছ বাবা?
দিলু বললো—চলো না আপা। আমি তো যাচ্ছি। তোমার ভালই লাগবে।
এখানে বসে থাকতেই আমার ভাল লাগছে।
ওসমান সাহেব বললেন—একা একা বসে থাকবি, খারাপ লাগবে না?
একা একা থাকব না। জামিল ভাই থাকবেন। কি জামিল ভাই, আমাকে একা ফেলে নিশ্চয়ই আপনি পাখি শিকারে যাবেন না? নাকি আপনিও যেতে চান?
না, আমি আছি।
রোদের তাপ বাড়ছে। মিষ্টি গন্ধ উঠে আসছে মাঠ থেকে। এ অঞ্চল বেশ নির্জন। মাঝে মাঝে দু-একটা মাছ ধরার নৌকা শুধু যাচ্ছে। নৌকায় বসে থাকা লোকজন তাদের দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু খুব একটা অবাক হচ্ছে না। স্পীড বোট নিয়ে শহরের লোকজন হয়তো প্রায়ই এদিকে শিকারে আসে।
নিশাত হাত বাড়িয়ে হাসি মুখে বললো—জামিল ভাই, এই কি সেই বিখ্যাত কাশফুল?
হুঁ। তবে এখনো ফুল ফুটেনি। সময় হয়নি।
কই, তেমন কিছু তো লাগছে না।
বাতাসে যখন ঢেউয়ের মত উঠানামা করে তখন ভালো লাগে। তুমি কি বোটেই বসে থাকবে না নামবে?
চলুন নামি। হিল পরে হাঁটা যাবে তো?
হিল পরে এসেছো?
হ্যাঁ, দেখছেন না কত লম্বা লাগছে আমাকে।
জামিল ঠিক বুঝতে পারছে না। নিশাতকে খুব খুশী খুশী মনে হচ্ছে। সাজগোজের মধ্যেও যথেষ্ট যত্নের ছাপ। ঠোঁটে কড়া করে লিপস্টিক দিয়েছে।
নিশাত বললো—গ্রাম-নদী এইসব কিন্তু আমার কাছে তেমন এক্সাইটিং মনে হয় না।
একেকজনের দেখার ক্ষমতা একেক রকম। সাব্বির সাহেব যা দেখে মুগ্ধ হবেন তুমি হয়তো তা দেখে মুগ্ধ হবে না। তাছাড়া…।
সাব্বির ভাইকে আপনার কেমন লাগে?
চমৎকার। ভদ্রলোক অল্প সময়ের মধ্যে আমাকে দারুণ ইমপ্রেস করেছেন। এই একটি লোক দেখলাম যার মধ্যে ভান নেই।
নিশাত ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললো—এত তাড়াতাড়ি একটা ডিসিশনে আসা ঠিক না। আপনি মানুষ সম্পর্কে খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্তে চলে আসেন। নিশাত খুব সাবধানে পা ফেলে এগুতে লাগলো।
জামিল বললো—জুতো পরে তোমার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। জুতো খুলে ফেলো।
খালি পায়ে হাঁটব?
হ্যাঁ। খারাপ লাগবে না। শুকনো পথঘাট।
নিশাত হিল খুলে ফেললো—খালি পায়ে হাঁটতে তার ভালই লাগলো। খুশী খুশী গলায় বললো—ফ্লাক্সটা নিয়ে এলে ভাল হতো। কোথাও বসে চা খাওয়া যেতো। শাড়ি পরা আট-ন বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে কোত্থেকে হঠাৎ এসে উদয় হয়েছে। চোখ বড় বড় করে দেখছে। নিশাত বললো—এ্যাই তোমার নাম কি? মেয়েটি জবাব দিলো না।
বাড়ি কোথায় তোমার?
মেয়েটি হাত বাড়িয়ে যেদিকে দেখালো সেদিকে কোন ঘরবাড়ি নেই।
জামিল ভাই, মেয়েটি কি হারিয়ে গেছে নাকি?
না, ওরা হারাবে না। গ্রামের মেয়ে, সমস্ত অঞ্চল এদের খুব ভাল করে চেনা। নিশাত, কোনদিকে যেতে চাও?
চলুন ঐ গাছটার নিচে বসি। কি গাছ ওটা, বিরাট বড় তো।
শিমুল গাছ।
শিমুল গাছে এত বড় বড় কাঁটা থাকে নাকি?
থাকে।
জামিল সিগারেট ধরালো। নিশাত হ্যাণ্ডব্যাগ থেকে সানগ্রাস বের করে চোখে দিলো। হালকা স্বরে বললো—একটা হাসির গল্প বলুন তো। দিলুকে রোজ কিসব গল্প বলেন। দেখি এবার আমি একটা শুনি।
দিলুকে হাসির গল্প বলি না। দিলুকে বলি ভূতের গল্প। ভূতের গল্প শুনতে চাইলে বলতে পারি।
নিশাত খিলখিল করে হেসে ফেললো। তার হাসি দেখে ছোট্ট মেয়েটাও হাসতে শুরু করলো। জামিল নিজেও হাসলো।
না জামিল ভাই, বলুন একটা হাসির গল্প। দেখি আপনি আমাকে হাসাতে পারেন কিনা।
হাসাতে পারলে কি দেবে?
আপনি আগে বলুন, তারপর দেখা যাবে।
টেলিফোনের খুঁটি বসানো হচ্ছে। সারাদিন ধরে কাজ চলছে। সন্ধ্যাবেলা ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কাজ দেখতে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন—তোমরা ক’টা খুঁটি পুঁতলে? ওরা বললো—স্যার বারটা। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বললেন—মন্দ না, বারটা খারাপ না। তারপর গেলেন অন্য একটা দলের কাছে—তোমরা কটা পুঁতলে? ওরা বললো—স্যার একটা। ইঞ্জিনিয়ার রেগে আগুন—এত কম? ঐ দল তো বারটা পুঁতলো। দলের সর্দার বললো—আমাদের কাজ আর ওদের কাজ? ওদের খুঁটির সবটাই মাটির উপর আর আমাদেরটা দেখুন। মাটির উপর আছে চার আঙুল। সবটাই ঢুকিয়ে দিয়েছি,
নিশাত গল্প শুনে হাসলো না। গম্ভীর হয়ে বললো—এই গল্পটা জামিল ভাই আপনি আমাকে ইচ্ছে করে বললেন।
ইচ্ছে করে বলব কেন?
গল্পটা বাবুর আব্বার।
হ্যাঁ, আমি কবিরের কাছ থেকে শুনেছি। এটা একটা চমৎকার গল্প, তাই তোমাকে বললাম। অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিলো না। সব কিছুতেই তুমি এত উদ্দেশ্য খোঁজ কেন?
নিশাত উঠে দাঁড়ালো—চলুন বোটে ফিরে যাই। ফেরার পথে কেউ কোন কথা বললো না। ছোট মেয়েটি আবার পেছনে পেছনে আসছে। খুব কৌতূহল মেয়েটির। ছোট্ট শাড়িটা পরেছেও খুব গুছিয়ে। শাড়ির রঙ গাঢ় সবুজ। তার মধ্যে লাল পাড়। জামিল বললো—নিশাত, তুমি কি লক্ষ্য করেছো বেশীর ভাগ গ্রামের মেয়ের শাড়ির রঙ সবুজ।