বুনো প্রজাপতি আবার কী? সব প্রজাপতিই তো বুনো। পোষা প্রজাপতি আবার আছে নাকি?
ঐ প্রজাপতিটির পাখায় কোন রঙ ছিলো না। কালো কালো দাগ। কাজেই বুনো প্রজাপতি বলেছি। আপনি কি ঐ ছবিটি দেখতে চান?
আছে আপনার কাছে?
হ্যাঁ। বসুন আপনি, আমি নিয়ে আসছি।
সাব্বির সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো।
সাব্বিরকে নিশাত কি আগে ভালো করে লক্ষ্য করেনি নাকি? বেশ লাগছে একে। মনে হচ্ছে এর মধ্যে ভান নেই। শুধু কথাবার্তা নয় চোখের দৃষ্টিও বেশ স্বচ্ছ। মেয়েদের মত বড় বড় চোখ। না কথাটা ঠিক হলো না। সব মেয়েদের চোখ বড় বড় নয়। বরং বলা উচিত মেয়েলী চোখ। পুরুষ মানুষকে এত বড় বড় চোখে মানায় না। না এটাও ঠিক হলো না। সাব্বির সাহেবকে তো ভালই মানিয়েছে। নিশাত বেশ আগ্রহ নিয়ে ছবির বইটির জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো। যেন এই আগ্রহ থাকাটা ঠিক নয়। এটা অন্যায়।
এত চমৎকার একটা ফটোগ্রাফির বই নিয়ে সাবির ফিরবে নিশাত আশা করেনি। সে দু’বার বললো—এ বইয়ের সব ছবি আপনার তোলা?
হ্যাঁ। ব্যাক কভারে ফটোগ্রাফারের ছবি আছে। দেখুন না।
আপনি তো বিখ্যাত ব্যক্তি।
হ্যাঁ। মোটামুটি বিখ্যাত। ঐ দেশে অনেকেই আমাকে চেনে।
নিশাত পাতা উল্টাতে লাগলো। অপূর্ব সব ছবি। মন খারাপ করিয়ে দেবার মত ছবি।
তিপান্ন পৃষ্ঠায় ঐ ছবিটি আছে। দেখুন। ঐ ছবিটি দিয়ে আমি ফটোগ্রাফির জগতে প্রথম এণ্ট্রি পাই।
নিশাত তিপ্পান্ন পৃষ্ঠা খুলে অনেকক্ষণ কোন কথা বলতে পারলো না।
ছবিটা ভাল লেগেছে?
হ্যাঁ। কিন্তু মেয়েটার গায়ে কোন কাপড় ছিলো না এই কথা আপনি আগে বলেননি। ও কি এইভাবে বনে বসেছিলো?
হ্যাঁ।
এবং আপনি ছবি তুলতে চাইতেই রাজি হয়ে গেলো? কোন আপত্তি করলো না?
না কোন আপত্তি করেনি।
ঐ মেয়েটির কি নাম?
নাম জানি না। ছবির জন্যে মেয়েটির নামের কোন প্রয়োজন নেই।
আমার মেয়েটির নাম জানতে ইচ্ছে হচ্ছে।
সাব্বির হেসে উঠলো। রোদ উঠে গেছে। কুয়াশা মিলিয়ে যাচ্ছে। কেমন চমৎকার লাগছে চারদিক। নিশাত নরম গলায় বললো—এই বইটি আমার কাছে থাকুক?
থাকুক।
নিশাত উঠে দাঁড়ালো। নিচুস্বরে বললো—যাই। সাব্বির বললো—আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।
বলুন।
দয়া করে রাগ করবেন না বা মন খারাপ করবেন না।
এমন কি কথা যে আমি রাগ করব?
সাব্বির অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বললো—আপনার আমার ভাল লেগেছে। শুধু ভাল লেগেছে বললে কম বলা হয়। আমার আরো কিছু বলা উচিত। কিন্তু আমি গুছিয়ে কিছু বলতে পারি না। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমার ভাল লাগার ব্যাপারটা আপনার মা’কে বলতে পারি।
নিশাত ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললো, কিন্তু কিছু বললো না, ঘাটের ধাপ ভেঙে উপরে উঠে এলো।
আপা, তুমি এখানে আর আমি সারা বাড়ি খুঁজছি।
কেন?
দিলু হাত নেড়ে নেড়ে বললো—আমরা সবাই মিলে শিকারে যাচ্ছি।
কোথায় যাচ্ছিস?
শিকারে। বালিহাঁস মারবো আমরা। এসো তাড়াতাড়ি নাশতা খেয়ে নাও। রোদ বেশী কড়া হলে হাঁস পাব না।
বাবু কোথায় রে?
জানি না কোথায়। তোমার জ্বর নেই তো?
নাহ্।
তোমাকে এত সুন্দর লাগছে কেন আপা?
সুন্দর সেই জন্যে সুন্দর লাগছে।
নিশাত হাসলো। আজকের দিনটি চমৎকারভাবে শুরু হয়েছে।
কুয়াশা নেই। ঝকঝকে রোদ উঠেছে। আকাশ, চৈত্রের আকাশের মত ঘন নীল। আহ্ চমৎকার একটি দিন।
আমার আছে জল – ০৯ম পরিচ্ছেদ
শিকারে যাবার প্রোগ্রাম হঠাৎ করেই হয়েছে। নীলগঞ্জ থানার ও সি সাহেব সকালবেলা একটি দোনলা বন্দুক আর একগাদা ছররা গুলি নিয়ে উপস্থিত—স্যার, শিকারে যাবেন নাকি? বড়গাঙ্গের চরে বালিহাঁস পড়েছে। কায়দামত একটা গুলি করতে পারলে বিশ-পঁচিশটা পাখি পড়বে।
বলেন কি?
স্যার, একটা স্পীডবোটের ব্যবস্থা করেছি।
ওসমান সাহেব বহুদিন পর উৎসাহিত বোধ করেন। শিকার করা অনেকদিন হয় না। শেষ শিকারে গিয়েছিলেন প্রায় পাঁচ বছর আগে।
ওসি সাহেব, তাহলে তো তাড়াতাড়ি রওনা হতে হয়।
জ্বি স্যার।
চা-টা খেয়েই রওনা দেব কি বলেন ও সি সাহেব?
ঠিক আছে স্যার।
ওসমান সাহেব ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। দীর্ঘদিন পর রক্তে যৌবনের উত্তেজনা অনুভব করেন। থানার ওসির মত একজন অধস্তন অফিসারকেও হঠাৎ বন্ধু স্থানীয় মনে হয়।
ও সি সাহেব।
জ্বি স্যার।
দিনটাও আজ শিকারের জন্যে ভালো। কুয়াশা নেই, কিছু নেই।
না স্যার কুয়াশা থাকলেই ভালো। পরিষ্কার দিন শিকারের জন্য না। একটু তাড়াতাড়ি করা দরকার স্যার।
প্রথমে ঠিক হয়েছিল সবাই যাবে। পাখি শিকার হোক বা না হোক নৌকা ভ্রমণ হবে কিন্তু সাব্বির যেতে রাজি হলো না। তার নাকি শিকারে তেমন উৎসাহ নেই। রেহানাও থেকে গেলেন। কারণ বাবুর গা গরম হয়েছে। সকালে একবার বমি করেছে। রেহানা ধরেই নিয়েছিলেন নিশাত বাবুকে রেখে যাবে না। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন নিশাত দিলুর মতই উৎসাহ নিয়ে সাজ করছে। অনেকদিন পর তার চোখ ঝমমল করছে।
স্পীড বোটটি আহামারি কিছু নয়। দেশী নৌকায় বার হর্স পাওয়ারের একটা মেশিন বসানো। বসবার জায়গা নেই। চারদিকে ভেজা। এটা বোধহয় মাছ আনা নেয়া করে। মাছের বোটকা গন্ধ। তবু দিলুর ভীষণ ভালো লাগছে। সে বসেছে জামিলের পাশে। বেণী দুলিয়ে দুলিয়ে ক্রমাগত গল্প করছে। ওসমান সাহেব হাসি মুখে বললেন—মেয়েটাতো বড্ড বক বক করতে পারে। সবাই হেসে উঠলো। দিলু মোটেও অপ্রস্তুত হলো না, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তার এক বান্ধবীর গল্প করতে শুরু করলো। তার নাম লীনা কিন্তু সবাই তাকে ডাকে বক লীনা কারণ সে বকের মত মাথা নীচু করে হাঁটে। দিলু মাথা নীচু করে ব্যাপারটা দেখালো। ওসমান সাহেব বললেন—আয় মা তুই আমার পাশে বসে গল্প কর। কিন্তু দিলু নড়লো না। সে জামিলের পাশেই বসে রইলো।